‘অপেক্ষা’ ঘুরে বেড়ায় তিলোত্তমার কোলাহল থেকে নিশ্চিন্দিপুর, তেলেনাপোঁতা হয়ে পদ্মানদীর পারে…. ধ্বনিল আহবান, ‘পুজো আর ১১১ দিন’

রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘একটু দূরে আসিয়া না দাঁড়াইতে পারিলে কোনো বড় জিনিসকে ঠিক বড় করিয়া দেখা যায় না।’ পুজোর আর ১১১ দিন।‌ ‘দূর’ বটে। তবু ‘দূর নয় বেশি দূর।’ এই ছোট নিমেষগুলো উপলব্ধি করতে গিয়ে মনে হয় খানিকটা নেই, অনেকটা আছে। যেন না ফোটা শিউলির গন্ধ এসে পড়েছে নাকে। লক্ষ কোটি প্রদীপের আলো জানলা দিয়ে এসে প্রবেশ করছে শয়নকক্ষে। যেন বহুদূরে কেউ জীর্ণ কাপড়ের সব কালিমাচিহ্ন ধুয়ে ফেলে পাটভাঙা কাপড় বের করে নিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে সদ্য কিশোরীর নূপুরনিক্কন, শোনা যাচ্ছে, ‘আমার এ ঘর বহু যতন করে,
ধুতে হবে, মুছতে হবে মোরে…’

চারদিকে তীব্র দাবদাহ। ‘মেঘ দে, পানি দে’ হাহাকার। তারই মাঝে এক নিমন্ত্রণপত্র, পুজো আসছে। যেন ওইটুকু হাসির জন্যই এত আয়োজন। যেন ওই পাঁচটি দিনে জীবন শুধুই সহজ, ভারহীন। সব বোঝা নামিয়ে দিয়েছে নির্দ্বিধায়। যেন জীবনের সমস্ত না পাওয়া, একটি পাওয়াতে এসে দাঁড়িয়েছে। ক্ষয় আছে, ক্লেশ আছে, জরা আছে বলেই বাতায়নপথে জীবনের গভীর আহ্বান। সকল কান্না ছাপিয়ে জেগে ওঠে দুটি শব্দ, ‘পুজো আসছে‌’। সেই চারটে দিনে কে শিশু? কে বৃদ্ধ? কত সহস্র বছর পেরিয়েও পুজোর আনন্দ জরাজীর্ণ হয়নি। আকাশভরা অন্ধকারের মাঝে পুজো যেন হয়ে ওঠে হঠাৎ আলোর ঝলকানি। ‘নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে?’ পোটোপাড়ায় ঠাকুরের বায়না, সারাবছর ধরে জমানো ভান্ডার ভাঙা, ঘামে ভিজে ধর্মতলা, গড়িয়াহাটে বাছাইপর্ব, নতুন নাটকের মহড়া, পাড়ার জলসার প্রস্তুতি, মেয়েটার মুখভার দেখে ছেলেটার মনখারাপ আর প্যান্ডেলে তখন, ‘লক্ষ্মীটি দোহাই তোমার’।

অক্টোবরের একচিলতে রোদ সাতরঙা এক পাখি হয়ে উড়ে উড়ে বেড়াবে নতুন বেডকভার, মাঠে ডাঁই করা বাঁশ, ময়দা মাখার সসপ্যান, পুজোবার্ষিকী হয়ে কোনো লাল পাঞ্জাবি কিংবা কাশফুল আঁকা আঁচলে। পাড়ার মোড়ে মোড়ে ঠাকুর আসবে মুখ বেঁধে। সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে বন্ধুকে ডাকতে যাওয়া। প্রতিবছর অষ্টমীতে একটাই পাঞ্জাবি, দেবীর পায়ের তলায় রাখা জলদর্পণে তাঁর আবছা মুখ। শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়া, যেখানে নদীর ধারে ভরে আছে কাশ। এরপর শীতের সন্ধে নামার মতোই ঝুপ করে শেষ হয়ে যাবে পুজো। জলে মিশিয়ে যেতে যেতে ‘বাপের বাড়ি’ র লোকেদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে মেয়ে। প্রতিমার মুখের মায়া মিশে যাবে মাঝরাতে ক্লান্ত হয়ে ফেরা লোকগুলোর মুখে। আলপথ ধরে ফিরে যাবে ঢাকী, সঙ্গে তার ছেলে।

অপেক্ষা দীর্ঘতর হয় শীতের রাতের মতো। অপেক্ষার বয়স কমলে মফঃস্বলের স্টেশন বাজারে কলেজ ফিরতি মেয়েদের ভিড় বাড়ে। পাড়ার মোড়ের সেলুনে সবাই তখন বায়োস্কোপের নায়ক। অটোর পিছনে রাজু ফুডস্টলের বিজ্ঞাপন। বাড়িতে বাড়িতে শ্রীহরি বস্ত্রালয়ের প্যাকেট। অপেক্ষার বয়স ফুরিয়ে গেলে ক্যালেন্ডারে লাল কালি পড়ে। বীজগণিত বই কুলুঙ্গিতে ওঠে আর তারিখ হয় বচ্ছরকার দিন।

১১১ দিন আসলে একটা করে কড় গোনা। কাজ ফুরনোর কড় গোনা, ঘরে ফেরার কড় গোনা। পাড়ার মোড়ে গান বাজে, ‘যেন কিছু মনে কোরো না, কেউ যদি কিছু বলে’। প্রেমিকার অভিমানী চোখ মনে করে টিকিট কাটে প্রেমিক। দুর্গাদের জন্য শাড়ি, পুতুল, আলতা কেনে সব হরিহরেরা। পুজোর আর ১০০ দিন। অপেক্ষা ঘুরে বেড়ায় ঝাঁ চকচকে শহর পেরিয়ে, শহরতলি হয়ে নিশ্চিন্দিপুর, তেলেনাপোঁতা কিংবা পদ্মানদীর পারে। ‘কেতুপুরে চার দিন পূজার ঢাকঢোল বাজিল— উৎসব হইল।’ উৎসব আর অপেক্ষার বেড়া হয় না, কাঁটাতারও না। আস্তাকুঁড়ে পুজো আসে, শ্মশানের ধারের গাছে শিউলি ফোটে। পুজোর গান বদলায়, থিম বদলায়। থেকে যায়, চুপিচুপি সিনেমা হল, আড়চোখের চাহুনি, ম্যাটিনি শো আর  ‘মনে রেখো পাড়ের শাড়ি, সোনায় জড়ানো শাঁখা।’  পুজো আর ১১১ দিন…