কলকাতা: প্রথম যেদিন নিজের রোজগারের টাকা হাতে এসেছিল, সেদিন বোধহয় আমরা সকলেই একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। যে স্বপ্নে ছিল একটা আশ্রয়, একটা ছাদ। একটা ছাদের সন্ধান। মনে হয়েছিল আরেকটু বাড়ুক পুঁজি। বাড়ির দরজায় লেখা থাকুক, নিজের নাম। সেই স্বপ্নে আমরা কেউ হেরে গিয়েছি, আবার কেউ জিতে। আর কেউ এমনও থেকে গেছি যারা হেরে যাব জেনেও জেতার চেষ্টা চালিয়ে গেছি। কোনও গোপন আর্তি অন্তঃসলীলা প্রবাহের মতো আমাদের বলে গিয়েছে, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’।
হাল ছাড়েনি মন্নু (তাপসী পান্নু)। নিজের বাড়ি অন্য়ের দখলে চলে যেতে দেখেছে। তবু জেদ কমেনি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গিয়েছে একটা পাসপোর্টের জন্য়। শুধু আটকেছে একটা জায়গাতেই, টাকা। আর এরপরেই ত্রাতা হয়ে এসেছেন হার্ডি (শাহরুখ খান)। তবে এই ত্রাতা ‘কাল হো না হো’-র ‘আমন মাথুর’ নয়। এই ‘শাহরুখ’ ফারিস্তা নয়। এই শাহরুখের নিজস্ব সংগ্রাম আছে। এই শাহরুখও মুখ থুবড়ে পড়ে। উঠে দাঁড়ায়। হাত ধরে। মাথা রাখার কাঁধ দেয়। পঞ্জাবের গ্রামের জনা চারেক যুবক-যুবতী, যাদের চোখে একরাশ স্বপ্ন, তাদের বিদেশ পৌঁছনোর মরণপণ লড়াইতে শাহরুখ হয়ে ওঠে একটা ভরসা আর আশ্বাসের সমার্থক।
২০২৩ বোধহয় শাহরুখের নামেই লেখা ছিল। এই বছরের শুরুতেই নিজের চার বছরের ব্য়র্থতায় জাদুকাঠি ছুঁইয়েছিলেন তিনি। বক্সঅফিস, বলিউড-বাণিজ্য় তোলপাড় করে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’। চার বছর ধরে ঝিমিয়ে থাকা শাহরুখ ভক্তরা ছিটকে গিয়েছিল এক লহমায়৷ ৫৭-বছরের লোকটা করছে কী! সেই রেশ কাটতে না কাটতেই আবার ‘জওয়ান’। নিজেকে কতভাবে ভেঙে কতভাবে গড়া যায়, আবারও প্রমাণ করে দিয়েছেন বাদশা। তার আগে থেকেই অবশ্য় সামনে এসে গিয়েছিল একটা ঝলক। একটা অভিবাসনের ছবি। আর দুটো নাম, শাহরুখ খান, রাজকুমার হিরানি।
মনে মনে কিছু ভাবনা তো ছিলই। আর ছিল কিছু ঝলক। ‘পিকে’, ‘থ্রি ইডিয়টস’ কিংবা ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’-র অন্ধভক্ত দর্শক কোথাও গিয়ে আন্দাজ করতে পেরেই ছিলেন ঠিক কতটা রোমাঞ্চকর হতে চলেছে এই দুই মশলার মিশেল। কিন্তু রান্না কেমন হল?
২০১৬র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে ট্রাম্প বলেছিলেন, সমস্ত বেআইনি অভিবাসীদের মেক্সিকো ফেরত পাঠানো হোক। কারণ তাদের একটাই তকমা। তারা অপরাধী। কিন্তু বাস্তবটা তো অন্য। তাঁরা এসেছিলেন রোজগারের আশায়। নিঃস্ব, সর্বহারা না হতে চেয়েও নিঃস্ব, সর্বহারাই হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। মেলেনি অঙ্ক। ‘ডাংকি’র প্লটও এমনটাই। প্রেক্ষাপটটা শুধু পঞ্জাব আর লন্ডন। এমন আঁটোসাঁটো সম্ভাবনাময় যেই ছবি, সেখানে শাহরুখের জাদু কোথায়? তিনি খামতি তো রাখেননি, কিন্তু রাজকীয় সেই সাজ, ক্য়ারিশ্মা কি দেখতে পেলেন দর্শক? না। এই ছবি হতে পারত আরও ভয়ঙ্কর সুন্দর। কিন্তু হিরো শাহরুখ অভিনেতা হওয়ার দৌড়ে বোধহয় খানিকটা পিছিয়েই গেলেন। যাঁর কাছে আশা ছিল আকাশছোঁয়া, একটু হতাশ তিনি করলেন বৈ কী!
তবে কয়েক মিনিটের উপস্থিতিতে ভিকি কৌশল আবারও চিনিয়ে দিয়েছেন নিজের জাত। সঞ্জুর কামলির কথা আবারও মনে পড়ে যাবে। মস্তিষ্কে শিলমোহর পড়ে যাবে, তাপসী পান্নু বলিউডের সেরা অভিনেত্রীদের একজন। রাজকুমার হিরানি বরাবরই বোমান ইরানিকে বিশেষ চরিত্র দিয়ে থাকেন। এখানেও তাঁর ব্য়তিক্রম হয়নি। তবে কোনও আইকনিক সংলাপ তৈরি করতে পারেননি তিনি। ‘ও মাহি’ ছাড়া একটা গানও মন ছোঁয়নি। কিন্তু শাহরুখ আবারও প্রেমিক। এবং প্রেমে তাঁর ধারেকাছে আর কেউ আসতে পারবে না, সেই একচ্ছত্র অধিকার তিনিই ধরে রেখেছেন। প্রেমিকার শ্বাস জাগিয়ে রাখতে নিজের শ্বাস বন্ধ করতে পারে যে, প্রেমিকার জন্য় ২৫ বছর অপেক্ষা করতে পারে যে, প্রেমিকার জন্য় প্রাণ নিতে পারে যে, আর প্রেমিকার জন্য় হেরে যেতে পারে যে, সেই তো প্রেমিক, সেই তো শাহরুখ।
ডাংকি দেখে স্বদেশ, চক দে ইন্ডিয়ার শাহরুখকে মনে পড়বে, মনে পড়বে ভির-জারার শাহরুখকে। আপনি এই মুহূর্তে হাসবেন, পরের মুহূর্তে কাঁদবেন। যাঁরা নায়ক শাহরুখের পরে অভিনেতা শাহরুখকে পেতে চেয়েছিলেন, তাঁরা পাবেন। তবে আরেকটু পেতেও ইচ্ছে করবে। ডাঙ্কি মুন্নাভাই বা থ্রি ইডিয়টস হয়নি। বছর শেষে ছক্কা না হাঁকালেও, শাহরুখে দর্শক সমর্পিত হবেনই। শাহরুখ শেখাবেন বিকল্প দেশপ্রেমের পাঠ দিতে, শেখাবেন ভালবাসার জন্য় অপেক্ষা করতে, আর আবার, বারবার বুঝিয়ে দেবেন পৃথিবীর প্রথম এবং শেষতম প্রেমিকের নাম শাহরুখ খান।
ডাংকি (৫ / ৩.৫)
অভিনয়- শাহরুখ খান, তাপসী পান্নু, ভিকি কৌশল, বোমন ইরানি
পরিচালক- রাজকুমার হিরানি