তমলুক: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজের স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করেছে তাম্রলিপ্ত রাজবাড়িবা তমলুক রাজবাড়ি। স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান তমলুক রাজবাড়ি। যার অলিন্দে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সভা করেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ভূমিকায় তমলুক রাজবাড়ি এক প্রবাহমান ইতিহাসের সাক্ষী। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকে লবণ আইন আন্দোলন, সবেতেই ইতিহাসে ছাপ রেখে যায় তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ি বা রাজ পরিবারের সদস্যরা।
তমলুক বা তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ির সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ির সম্পত্তি নিয়ে রাণীকৃষ্ণপ্রিয়ার ব্রিটিশদের লড়াই ব্রিটিশবিরোধী শক্তির ভিত পোতা হয় তমলুক রাজবাড়ির অন্দরে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে তমলুকে তৎকালীন রাজা সুরেন্দ্র নারায়ণ রায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। তমলুকে ব্রিটিশ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সভা হয় সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন রাজা সুরেন্দ্র নারায়ণ রায়। এই সভা ছিল অবিভক্ত তমলুক মহাকুমার প্রথম বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী সভা।
১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে রাজা সুরেন্দ্র নারায়ণ রায় মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে অবিভক্ত তমলুক মহাকুমার লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনকারীদের বসবাসের জন্য রাজবাড়ির একাংশ ছেড়ে দেন। এই রাজবাড়িতে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনকারীদের শিবির থেকেই লবণ সত্যাগ্রহের আচার্য ও উপাচার্য হিসেবে নির্বাচিত হয় সতীশ সামন্ত ও সুশীল কুমার ধাড়া।
রাজবাড়ি থেকেই সত্যাগ্রহীরা লবণ আইন ভঙ্গের উদ্দেশ্যে নরঘাট গিয়েছিলেন। ফল স্বরূপ ব্রিটিশ বাহিনী রাজা সুরেন্দ্র নারায়ণ রায়কে গ্রেফতার করে। রাজা সুরেন্দ্র নারায়ণ রায়ের পুত্র ধীরেন্দ্র নারায়ণ রায় লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেওয়ায়। ১৬ এপ্রিল ১৯৩০ সালে গ্রেফতার করে। এক বছরের কারাদণ্ড ভোগ করে। প্রথমে তমলুক জেল, তারপর নিয়ে যাওয়া হয় মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে এক বছর কারাবাস করতে হয়। রাজা সুরেন্দ্র নারায়ণের অপর এক পুত্র হরেন্দ্র নারায়ণকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করে বিচারে তাকে শহর ছাড়ার নির্দেশ দেয় ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর।
কিন্তু তাতে তিনি দমবার পাত্র নয় আত্মগোপন করে রইলেন শহরেই। আর স্বদেশীদের নানাভাবে সাহায্য করতে থাকেন। প্রথমে ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি ধরা পড়েন। ১৯৩৮ সাল তৎকালীন কংগ্রেসের সভাপতি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ১১ এপ্রিল তিনি তমলুক শহরে এলেন। শহরে কংগ্রেসের সভা অনুষ্ঠিত হবে কিন্তু সভা করার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। তখন এগিয়ে এল তাম্রলিপ্ত বা তমলুক রাজপরিবার।
সেই সময় কংগ্রেসের নেতাগণ শরণাপন্ন হয় বৃদ্ধ রাজা সুরেন্দ্র নারায়ণ রায়ের। বৃদ্ধ রাজা রাজবাড়ির অন্দরে খোসরঙের মাঠের ফলন্ত আমবাগান কেটে সুভাষচন্দ্রের সভার আয়োজন করেন। ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনেও এই রাজ পরিবারের সদস্যরা অংশ নেয়। রাজ পরিবারের সন্তান কুমারেন্দ্র নারায়ণ রায় এই আন্দোলনে অংশ নেয় ছাত্রাবস্থায়। ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে স্বদেশী বিপ্লবীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিপ্লবীদের আখড়া রক্ষিত বাড়ি যখন ব্রিটিশ পুলিশদের কুনজরে আসে, তখন রক্ষিত বাড়িতেই অনুশীলন সমিতি রাজবাড়িতে স্থানান্তরিত করে স্বদেশীরা। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তমলুক রাজবাড়ি এক উল্লেখযোগ্য স্থান নিয়েছে।
সৈকত শী