দিন ফুরায়, ভালবাসায় পাক ধরে… নিকটজনে মুখ ফেরালে মুশকিল-আসান তো তারাই… ‘পরানসখা, বন্ধু হে আমার…’

শহর শেষ শহরতলি, তা পেরিয়ে শুরু হচ্ছে কোনও এক গ্রাম। ধরা যাক, তার নাম… থাক! নামে কী এসে যায়! সেখানেই হয়তো থাকে দুই বন্ধু। একজনের কুঁচি হাতা চিকনের জামা, ঝোলা বেনি হাঁটু ছুঁয়েছে। আরেকটা তার নাম জানে না কেউ। পাড়ায় সবাই ডাকে গেঁড়ি বলে। মাথায় বাটিছাঁট চুল। হাফ-প্যাডেল করে এগিয়ে চলেছে অন্য কোথাও,অন্য কোনও খানে। যেখানে আঁধার হল মাদার গাছের তলা, কালি হয়ে এলো দিঘির জল। কিংবা শহরতলির কোনও এক ভাঙা-বাড়ি, তার নোনা ধরা দেওয়াল। খাটে বিছানো লুডো-আঁকা মাদুর। রবিবারের সকালে অঙ্ক করানোর হিড়িক। কুঁচোর মনে তখন, ‘মাগো আমায় ছুটি দিতে বল, সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা…’ বাইরে তখন সাইকেলের ঘণ্টি এসে হাজির। আজ দুপুর থেকে খেলা। হাতে আধ খাওয়া পেয়ারা। বাকি অর্ধেকটা বন্ধুর জন্য সযত্নে তোলা। গতকাল স্কুলে এই পেয়ারা-পাড়া নিয়েই যত তো অশান্তি। আজ বন্ধুকে ভাগ না দিলে হয়!

আজ অগাস্টের প্রথম রবিবার। বন্ধুত্ব দিবস, ফ্রেন্ডশিপ ডে। জাতিসংঘের মতে, ৩০ জুলাই আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস। ভারত, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও অগাস্ট মাসের প্রথম রবিবারকে বেছে নেওয়া হয় ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’ হিসেবে। কবে থেকে শুরু হল ফ্রেন্ডশিপ ডে পালন? যার শুরুটা কিন্তু ভারী মজার। গ্রিটিং কার্ড ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ১৯২০ সালে গ্রিটিং কার্ড বিক্রি বাড়ানোর জন্য বন্ধুত্ব দিবসের ধারণাটি প্রচলন করে। ২০১১ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভা ৩০ জুলাই তারিখটিকে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ভারতে প্রতি বছর বন্ধুত্ব দিবস পালিত হয়ে আসছে অগাস্ট মাসের প্রথম রবিবার। এত তথ্য, তত্ত্ব ওরা জানে না। ওরা জানে পরের দিন স্কুল খুললে বন্ধুর হাতে বেঁধে দিতে হবে রংবেরংয়ের ব্যান্ড। যারটা যত অভিনব, তার কদর এ দিন তত বেশি। রাস্তার ধারের দোকানগুলোতে সার বেঁধে ঝুলছে বন্ধুত্বের বাঁধন। ওরা কথা দিতে শেখেনি। ওরা শিখেছে হাতে হাত রাখতে, বেঁধে বেঁধে থাকতে।

বালক রবীন্দ্রনাথের কোনও বন্ধু ছিল না। তাঁর সখ্য ছিল প্রকৃতির সঙ্গে। ‘দক্ষিণের বারান্দার রেলিঙ ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতুম। শেষকালে এল সেই পুকুরের কাল ঘনিয়ে, পড়ল তার মধ্যে গাড়ি-গাড়ি রাবিশ। পুকুরটা বুজে যেতেই পাড়াগাঁয়ের সবুজ-ছায়া-পড়া আয়নাটা যেন গেল সরে। সেই বাদামগাছটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু অমন পা ফাঁক করে দাঁড়াবার সুবিধে থাকতেও সেই ব্রহ্মদত্যির ঠিকানা আর পাওয়া যায় না।’ সেই রবির বন্ধু হলেন তাঁর নতুন বৌঠান। তাঁরা একত্রে খেলেছেন, একত্রে হেসেছেন, পুতুল বিয়ে দিয়েছেন। তারপর তাঁর সেই বন্ধুত্বের বাঁধনও ছিঁড়ল। এলেন নতুন কেউ। কবি লিখেলেন, ‘হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে… বালককে খেলাইছে বালিকা’। তাঁর কাব্যে-গানে কখন যেন এক হয়ে গেল প্রেম, বন্ধুত্ব। রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য তার শেষ চিঠির শেষ পাতায় নিজের প্রেমিককে সম্বোধন করেছেন ‘বন্ধু’ বলে। কবি আবার লিখেছেন, ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়’। কিংবা প্রিয় ঝড়ের রাতে তাঁর কলমে এসেছে, ‘পরানসখা, বন্ধু হে আমার’।

হস্টেলের নোনোধরা দেওয়াল। একটা থালায় চারটে খোপ। পাতলা ডাল, তাতে জল বেশি। মাছের বড় পিসটা কার পাতে? বন্ধুত্ব পৌঁছে যায় গলি থেকে রাজপথ। শতক পুরনো বন্ধুত্ব দিবসের ইতিহাস কেউ মনে রাখে না। সদ্য কিশোরের বন্ধু হয় অকালপক্ক ছোঁড়া। বন্ধুত্বের নাছোড়বান্দা গতি সীমা-পরিসীমা মানে না। তা কখনও নামভূমিকার তোয়াক্কা না করে পৌঁছে যায়, প্রেমের ঘরে টোকা মারে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘বন্ধুত্ব ও ভালবাসায় অনেক তফাৎ আছে, কিন্তু ঝট্ করিয়া সে তফাৎ ধরা যায় না। বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালবাসা পোশাকী।’ বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড় দুই-এক জায়গায় ছেঁড়ে। তবু তা গায়ে দিলে একরকম আরাম। যিনি বলেছেন, ‘বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না’ তিনি মনেপ্রাণে সত্যি। চার দেওয়ালের বাইরে আমাদের প্রথম সম্পর্কের নাম তো বন্ধুই। তারপর তো প্রেম। ভাবের জগতে কার কদর বেশি, সে আমরা কে না জানি…’ সেই যে কোন কালে তিনি লিখে গিয়েছেন, ‘ প্রেম মন্দির ও বন্ধুত্ব বাসস্থান। মন্দির হইতে যখন দেবতা চলিয়া যায় তখন সে আর বাসস্থানের কাজে লাগিতে পারে না, কিন্তু বাসস্থানে দেবতা প্রতিষ্ঠা করা যায়।’

বন্ধুত্ব অটুট হোক। বন্ধুত্বের ফাটল থেকে জন্ম নিক নতুন সবুজ পাতা। শুভ বন্ধু-দিন…