অরুণ আনন্দ
তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মের আধ্যাত্মিক গুরু দলাই লামা আবার উঠে এলেন সংবাদ শিরোনামে। আগামী বছর জুলাই মাসে তিনি ৯০ বছর বয়সে পা দেবেন। সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন, সামনের জুলাই মাসে, তিনি তাঁর পুনর্জন্মের বিষয়ে আলোচনা করবেন। তবে চিনা সরকার সমর্থিত চিনা-তিব্বতি বুদ্ধিস্ট অ্যাকাডেমি দলাই লামার এই মন্তব্য শুনে থেমে থাকেনি। চলতি মাসে, চিনের লানঝৌ প্রদেশে এই সমিতিটি দলাই লামার মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের জন্য একটি সেমিনারের আয়োজন করে। তাদের কথা অনুযায়ী: যেই আধ্যাত্মিক শক্তিই এই পবিত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করুক না কেন, তা চিনের কমিউনিস্ট পার্টির কঠোর নিয়মাবলীর মধ্যে দিয়ে করতে হবে।
গোষ্ঠীটির এই বার্তা অপমানজনক হলেও তা উদ্দেশ্যমূলক বলেই মনে করা হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে, চিন চাইছে পরবর্তী দলাই লামা কে হবে তা তারাই ঠিক করে দেবে। বর্তমানের অশীতিপর দলাই লামার গোটা বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয়তা এবং তিব্বতিদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখার ক্ষমতা, চিনের মাথাব্যথার কারণ। চিন তাই বরাবর চেয়ে এসেছে, পরবর্তী দলাই লামার নির্বাচন তাদের তরফ থেকে হোক।
চিনের কমিউনিস্ট পার্টি বহু বছর ধরে চেষ্টা করে আসছে, দলাই লামার শক্তি ও ক্ষমতা নষ্ট করার। ১৯৮৯ সালে নোবেলপ্রাপ্ত দলাই লামা এমন এক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব যার আন্তর্জাতিক সুখ্যাতি তিব্বতিদের একতা রক্ষায় বহুদিন ধরে কাজ করে আসছে। লানঝৌতে হওয়া অধিবেশনে, চিনা কমিউনিস্ট পার্টির পুনর্জন্ম নীতিগুলিতে আবার আতশ কাচের নীচে ফেলা হয়। জোর দেওয়া হয় সব নীতিগুলিতে। পুনর্জন্মের বিভিন্ন নীতিগুলি যেন শি জিনপিংয়ের চিন্তাভাবনা ও পার্টির নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাতেও নজর দেওয়া হবে বলে প্রস্তাব পাশ হয়।
আরও পড়ুন: ঘটনাস্থলে কী কী এমন মিলেছিল! আরজি করের সেই রাতে যা ঘটে, চার্জশিটে ভয়ঙ্কর তথ্য দিল সিবিআই
বেজিংয়ের অফিসিয়াল মিডিয়ার রিপোর্ট মোতাবেক, সেমিনারে তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধি এবং তিব্বতের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল যেমন, চিংহাই, সিচুয়ান ও গানসু প্রদেশের বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন। তিব্বত সরকারের দ্বারা নির্বাসিত অপর পক্ষ থেকে এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এই নির্বাসিত পক্ষই ১৯৫৯ সালে দলাই লামার উত্থানের কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়।
তিব্বতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি সিকিয়ং পেনপা শেরিং এই সেমিনারের পরিপ্রেক্ষিতে জানান, ১৪ তম দলাই লামার পুনর্জন্মে, কোনও সরকার অথবা ব্যক্তির নাক গলানোর অধিকার নেই
কে এই দলাই লামা?
‘লামা’ শব্দের অর্থ হল, শিক্ষক অথবা গুরু। একজন লামাকে অবশ্যই সন্ন্যাসী হতে হবে। তাঁর খ্যাতি সুদূরপ্রসারী হতে হবে এবং তাঁর যেন নিজের সম্প্রদায়ে অবশ্যই নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা থাকে। প্রসঙ্গত, তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে শতাধিক ‘লামা’ অর্থাৎ শিক্ষাগুরু রয়েছেন বলে মনে করা হয়। ভক্তরা দলাই লামাকে অবলোকিতেশ্বর হিসাবে গণ্য করেন। যা দয়ার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়।
বর্তমানের দলাই লামা হলেন তেনজিং গিয়াতসো, যিনি ১৪ তম লামা হিসাবে তিব্বতিদের কাছে বন্দিত। ভক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী ১৩৯১ সালে প্রথম দলাই লামার জন্ম হয়। তিব্বতিরা মনে করেন, দলাই লামা বারবার জন্ম নেন এবং ক্রমান্বয়ে তিনি আধ্যাত্মিক গুরুর ভূমিকা বজায় রাখেন।
আধ্যাত্মিক গুরু হিসাবে গোটা বিশ্ব তাকে দেখলেও, তিব্বতিদের কাছে তিনি আপনজন। কয়েক হাজার তিব্বতি যারা নিজের ঘর ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা তাঁকে পিতৃস্বরূপ মনে করেন। দলাই লামাও এই বিতাড়িত তিব্বতিদের বিভিন্ন প্রয়োজন মিটিয়েছেন। নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা সবই তিনি ব্যবস্থা করেছেন এই মানুষগুলির জন্য।
দলাই লামা নির্বাচনের প্রক্রিয়া হয় কী ভাবে?
তিব্বতি বৌদ্ধদের বিশ্বাস অনুযায়ী, দলাই লামার প্রয়াণের পর তিনি আবার পুনর্জন্ম নেন। নেতৃস্থানীয় ভিক্ষু ও লামাদের নিয়ে গঠিত নতুন দলাই লামা অনুসন্ধানের এক কমিটি রয়েছে যারা, দলাই লামার মৃত্যু পর একবছরের মধ্যে সদ্যোজাত শিশুকে চিহ্নিত করে, যার মধ্যে বিগত দলাই লামার সব গুণাবলী ও আচরণ লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান যিনি দলাই লামা পদে আসীন আছেন, তাকেও দুই বছর বয়সে খুঁজে নেওয়া হয়েছিল
দলাই লামা নির্বাচন নিয়ে এত বিতর্ক কেন?
দলাই লামার নির্বাচন বিয়ে বিতর্ক বরাবর! দলাই লামা উত্তরাধিকার বাছাই করার প্রক্রিয়া, বৌদ্ধ সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা স্পষ্ট করে আসছে বরাবর। চীন চায় দলাই লামা নির্বাচনের প্রক্রিয়া পুরোপুরি তাদের মাধ্যমে হোক। দলাই লামা নির্বাচনের উপর চীন নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। পরবর্তী দলাই লামা নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে তিব্বত এবং চীনের তিব্বতিদের উপর চীন কড়া কর্তৃত্ব আনতে চায়। ৬ মিলিয়নের বেশি তিব্বতি চিনে বাস করে। ১,৫০,০০০ এর উপরে তিব্বতি এখনও নির্বাসনে রয়েছে।
চলতি মাসে চিন তিব্বত বৌদ্ধ অ্যাকাডেমির বৈঠকে চিন সরকার সমর্থিত দলাই লামা নির্বাচন প্রক্রিয়া, ”গোল্ডেন আর্ন সিলেকশন” সার্বিক প্রচারের চেষ্টা করা হয়েছিল। এই পদ্ধতিও বিশেষ করে কুইং রাজবংশের আধিপত্যের সময় জনপ্রিয়তা পায়। চিনের এই উত্তরাধিকার নির্বাচন পদ্ধতি তিব্বতিদের দলাই লামা নির্বাচন পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খায় না। বরাবরই তিব্বতিদের মধ্যে থেকে নেতা নির্বাচনে চিন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তা বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার দরুন, চিনের তরফ থেকে ১৯৯৫ সালে দলাই লামার পর দ্বিতীয় সর্বাধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ৫ বছরের পাঞ্চেন লামাকে ১৯৯৫ সালে অপহরণ করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে বেজিং নিজেদের সুবিধার্থে পাঞ্চেনকে ব্যবহার করে পরবর্তী দলাই লামা নির্বাচনে কাজে লাগবে।
দলাই লামা তাঁর পুনর্জন্ম নিয়ে কী কী বলেছেন?
দলাই লামা তাঁর পুনর্জন্ম নিয়ে বেশ কিছু কথা বলে গেছেন। তাঁর মতে, যদি তাঁর মৃত্যু নির্বাসনে থাকাকালীন হয়, তবে তাঁর পুনরায় জন্মও নির্বাসনে থাকাকালীন হবে, তিব্বতে নয়।
সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যেই কথা তিনি বলেছেন তা হল, কোনও নারী তাঁর প্রয়াণের পর প্রথমবার দলাই লামা হিসাবে নির্বাচিত হতে পারে। তিনি তাঁর মৃত্যুর আগে তাঁর উত্তরাধিকারীকে নির্বাচন করে যেতে পারবেন। বর্তমান দলাই লামা আশা করেন, তিনি আরও ২০ বছর বেঁচে থাকবেন।
বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট অরুণ আনন্দ, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। তার লেখা প্রবন্ধ ও বই পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। আপনি তাকে তার X (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেল @ArunAnandLive -এ অনুসরণ করতে পারেন।