কলকাতা: রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের নিট মুনাফা আগের তিন মাসের তুলনায় ৯.৪ শতাংশ বেড়ে ১৬,৫৬৩ কোটি টাকা হল। যা বিশ্লেষকদের প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। টেলিকম ও খুচরো ব্যবসায় শক্তিশালী বৃদ্ধিই এর প্রধান চালিকাশক্তি।
৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া ত্রৈমাসিকে অপারেশন থেকে কোম্পানির আয় দাঁড়িয়েছে ২.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা। যা আগের ত্রৈমাসিকে ২.৩৬ লক্ষ কোটি ছিল।
মানিকন্ট্রোলের সাতটি ব্রোকারেজ হাউসের সমীক্ষা অনুযায়ী, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের আয় সামান্য কমে ২.৩১ লক্ষ কোটি টাকা এবং নিট মুনাফা ১২ শতাংশ কমে ১৫,৩৫৪ কোটি টাকা হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল। আসবে বলে প্রত্যাশা ছিল।
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মুকেশ আম্বানি বলেন, “ডিজিটাল সার্ভিসেস এবং আপস্ট্রিম ব্যবসার ব্যাপক বৃদ্ধি এই পারফরম্যান্সে প্রতিফলিত হয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা-সরবরাহের জটিল দ্বন্দ্বের কারণে দূর্বল হয়েছে O2C (অয়েল টু কেমিক্যাল) ব্যবসার কিছুটা ক্ষতিপূরণ করেছে।’’
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের তরফে জানানো হয়েছে, টেলিকম ইউনিট জিও-এর মাসিক ARPU (গ্রাহক পিছু গড় আয়) বছরে ৭.৪ শতাংশ বেড়ে ১৯৫.১ টাকায় পৌঁছেছে। কোম্পানির মতে, ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রভাব আগামী ২-৩ প্রান্তিকের মধ্যে দেখা যাবে। এছাড়া জিও তাদের 5G পরিষেবাকে আরও শক্তিশালী করছে। ১৪৮ মিলিয়ন গ্রাহক খুব দ্রুত এই পরিষেবায় আপগ্রেড করেছেন। রিলায়েন্স জিওর জন্য ওয়্যারলেস ডেটা ট্রাফিকের ৩৪ শতাংশ অবদান এসেছে এই বিভাগ থেকে।
রিলায়েন্সের ডিজিটাল পরিষেবার ব্যবসাগুলি নিয়ে গঠিত জিও প্ল্যাটফর্মস এই প্রান্তিকে রেকর্ড ৬,৫৩৬ কোটি টাকার মুনাফা করেছে। মুকেশ আম্বানি বলেছেন, “ডিজিটাল পরিষেবা খাতে এই বৃদ্ধির পিছনে রয়েছে ARPU এবং আরও বেশি সংখ্যক গ্রাহকের যোগদান, যা আমাদের পরিষেবার উন্নতির ইঙ্গিত দেয়।“
রিলায়েন্স রিটেল ভেঞ্চার্স সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ২,৯৩৫ কোটি টাকার কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে। যা আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। রিটেল ইউনিটের অপারেশন থেকে আয় বেড়ে ৬৬,৫০২ কোটি টাকা হয়েছে, যা আগের তিন মাসে ছিল ৬৬,২৬০ কোটি টাকা।
এই প্রসঙ্গে একটি বিবৃতিতে মুকেশ আম্বানি বলেছেন, “রিটেল বিভাগ তার কাস্টমার টাচপয়েন্ট এবং পণ্য প্রদানের পরিসরকে ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে, যা ফিজ্যিকাল এবং ডিজিটাল উভয় চ্যানেলের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এই অনন্য ওমনি-চ্যানেল জুড়ে রিটেল মডেল বিস্তৃত, বৈচিত্র্যময় গ্রাহক ভিত্তির বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা পূরণে সক্ষম।“
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ তাদের চারটি প্রধান খাতে শক্তিশালী পারফরম্যান্স দেখিয়েছে – অয়েল টু কেমিক্যাল, জিও প্ল্যাটফর্মস, রিটেল এবং তেল ও গ্যাস।
অয়েল টু কেমিক্যাল
অয়েল টু কেমিক্যাল (O2C) ব্যবসায় সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কোম্পানির রাজস্ব ৫.১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১.৫৫ লাখ কোটি টাকা হয়েছে, যা এক বছর আগের এই সময়ে ১.৪৭ লাখ কোটি টাকা ছিল।
সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে EBITDA দাঁড়িয়েছে ১২,৪১৩ কোটি টাকা, যা গত বছরের এই সময়ে ছিল ১৬,২৭৭ কোটি টাকা। কোম্পানি জানিয়েছে, চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ায় পরিবহন জ্বালানি খাতে ৫০ শতাংশ পতন এবং নিম্নমুখী রাসায়নিক ডেল্টাগুলিতে দুর্বলতা সৃষ্টি করেছে।
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সিএফও ভেঙ্কটাচারি শ্রীকান্ত বলেছেন,”গত বছর এই পতন আরও বেশি ছিল। তেলের চাহিদাও অপেক্ষাকৃত দুর্বল। যদিও আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে পণ্যের সরবরাহ বেড়েছে। অপরিশোধিত তেলের দাম এবং পণ্যের দামে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা গিয়েছে।“
সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পলিমার ও পলিয়েস্টারের চাহিদা কমেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। শ্রীকান্তর কথায়, “২০২৪ এবং ২০২৫ সালে তেলের মোট চাহিদা প্রতিদিন ১ মিলিয়ন ব্যারেলেরও কম হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে এই চাহিদা ২.১ মিলিয়ন ব্যারেল বৃদ্ধি পেয়েছিল।”
তবে তিনি আশা করেন যে, আসন্ন উৎসবের মরশুমে ভারতের নিম্নমুখী চাহিদার পালে হাওয়া লাগবে। পাশাপাশি চিনের বেশ কিছু পদক্ষেপ O2C সেগমেন্টের নিম্নমুখী মার্জিনে উন্নতি ঘটাবে। O2C ব্যবসার মধ্যে রয়েছে শোধনাগার, পেট্রোকেমিক্যালস, রিলায়েন্স BP মোবিলিটি লিমিটেডের মাধ্যমে জ্বালানি খুচরো বিক্রয়, বিমানের জ্বালানী এবং পাইকারি বাজারজাতকরণ। কোম্পানিটি আলাদাভাবে GRM-এর তথ্য জানায় না, তবে সিঙ্গাপুরের GRM-এর তুলনায় তা ভাল ফল করেছে।
তেল ও গ্যাস
তেল ও গ্যাস ব্যবসায় সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে রেকর্ড ৫,২৯০ কোটি টাকার EBITDA দাঁড়িয়েছে কোম্পানির। যা এক বছর আগের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি।
তেল ও গ্যাস বিভাগের রাজস্ব ৬,২২২ কোটি টাকা হয়েছে, যা গত বছর ছিল ৬,৬২০ কোটি টাকা। এর প্রধান কারণ কম দাম। তবে KGD6 এবং CBM ক্ষেত্রের গ্যাস ও কনডেনসেটের পরিমাণ বৃদ্ধি আংশিকভাবে এই ক্ষতি পূরণ করেছে।
KG D6 গ্যাসের গড় মূল্য সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রতি MMBTU (মিলিয়ন মেট্রিক ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) পিছু ছিল ৯.৫৫ ডলার, যা ২৪ অর্থবর্ষের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় কম। সেই সময় মূল্য ছিল ১০.৪৬ ডলার। MMBTU। CBM (কয়লা স্তর মিথেন) গ্যাসের গড় মূল্য সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে MMBTU পিছু দাঁড়িয়েছে ১১.৪ ডলার, যা গত বছরের এই সময়ে ছিল MMBTU পিছু ১৩.৭২ ডলার।
জিও প্ল্যাটফর্মস
সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে রেকর্ড ৬,৫৩৬ কোটি টাকার মুনাফা করেছে জিও প্ল্যাটফর্মস। বৃদ্ধি হয়েছে ২৩.৪ শতাংশ। এই বৃদ্ধির মূল কারণ ছিল গ্রাহক এবং ট্যারিফ বৃদ্ধি। টেলিকম এবং স্ট্রিমিং ব্যবসার রাজস্ব ১৮ শতাংশ বেড়ে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ৩১,৭০৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
টেলিকম কোম্পানির কর্মক্ষমতা পরিমাপের গুরুত্বপূর্ণ সূচক ARPU (প্রতি গ্রাহকের গড় আয়) ৭.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে বছরে ১৯৫.১ টাকা হয়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জিওর গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৪৭৯ মিলিয়নে পৌঁছেছে, অর্থাৎ ৪.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
রিলায়েন্স জিও ইনফোকমের চেয়ারম্যান আকাশ এম আম্বানি বলেছেন, “প্রথম থেকেই জিও গভীর প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের উপর জোর দিয়েছে। জিও ট্রু 5G এবং জিওএয়ার ফাইবার ভারতের ডিজিটাল ল্যান্ডস্কেপে যে রূপান্তর ঘটিয়েছে তা এই পদ্ধতির প্রমাণ। আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স এই রূপান্তরকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। জিও বিশ্বের সেরা এআই ইকোসিস্টেম তৈরিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
কোম্পানিটি আরও জানিয়েছে যে, জিওএয়ার ফাইবারের দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা হোম কানেকশনের গতি বাড়িয়েছে, ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২.৮ মিলিয়ন বাড়িতে জিওএয়ার ফাইবার সংযোগ দেওয়া হয়েছে। জিওর হোম কানেকশনের স্পিড আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি।
জিও প্ল্যাটফর্মসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, অংশুমান ঠাকুর বলেছেন, ‘‘আমরা হোম সেক্টরে দ্রুত এগোচ্ছি। জিওএয়ার ফাইবার অফারিং আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস প্রদানকারী সংস্থা। এই প্রান্তিকে আমরা ২.৮ মিলিয়ন গ্রাহকের কাছে পৌঁছেছি। এয়ার ফাইবার আমাদের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করেছে। রান টাইমও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।”
অংশুমান ঠাকুর আরও যোগ করেন, ‘‘আমরা 5G পরিষেবার বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছি। ১৪৮ মিলিয়ন গ্রাহক 5G-তে চলে এসেছেন। এটা ওয়্যারলেস ডেটা ট্যারিফের ২৪ শতাংশ অবদান রাখছে। আমরা পরিষেবা গ্রহণ এবং বিতরণ প্রক্রিয়ায় সন্তুষ্ট। তবে আরও উন্নতির আশা রাখি।’’
ARPU বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন যে, ARPU-এর এই বৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে ঘটছে। ‘‘ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রভাব রয়েছে, তবে এর পাশাপাশি গ্রাহকরা হায়ার প্ল্যানে আপগ্রেড করছে। কিছু অতিরিক্ত পরিষেবা আমরা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করতে পেরেছি। যা ARPU বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।”
খুচরো এবং মিডিয়া
রিলায়েন্সের খুচরো শাখা রিলায়েন্স রিটেল, সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ২,৯৩৫ কোটি টাকার নিট মুনাফা করেছে, যা এই বছরে ৫.২ শতাংশ এবং আগের প্রান্তিকের তুলনায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
EBITDA বেড়ে ৫,৮৫০ কোটি টাকা হয়েছে এবং EBITDA মার্জিন ৩০ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ৮.৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
কোম্পানি এই প্রান্তিকে ৪৬৪টি নতুন স্টোর খুলেছে, ফলে মোট স্টোরের সংখ্যা দাঁড়াল ১৮,৯৪৬ টি। স্টোরের মোট এলাকা ৭৯.৪ মিলিয়ন বর্গফুট। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে মোট ফুটফল দাঁড়িয়েছে ২৯৭ মিলিয়ন, যা গত বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে।
ডিজিটাল কমার্স এবং নিউ কমার্সকে আরও ছড়িয়ে দিয়েছে কোম্পানি। এই চ্যানেলগুলি মোট রাজস্বের ১৭ শতাংশ অবদান রেখেছে। এমনটাই জানানো হয়েছে কোম্পানির তরফে।
রিলায়েন্স রিটেল ভেঞ্চার লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ঈশা এম আম্বানি বলেছেন, ‘‘ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী ভিত গড়তে প্রযুক্তি এবং অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ জারি রেখেছে রিলায়েন্স রিটেল। বাজারে নেতৃত্ব স্থান ধরে রেখেছে। আমরা প্রতিনিয়ত প্রোডাক্ট পরিসর বাড়াচ্ছি। বিভিন্ন ক্যাটাগরি তৈরির মাধ্যমে এমন কেনাকাটার অভিজ্ঞতা তৈরি করছি যা গ্রাহকদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করে এবং খুচরো ক্ষেত্রে আমাদের নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী করে।”
উৎসব মরশুমে গ্রাহকের চাহিদা সম্পর্কে রিলায়েন্স রিটেলের CFO এবং কর্পোরেট ডেভেলপমেন্টের প্রধান, দিনেশ তালুজা বলেন, ‘‘উৎসব মরশুম শুরু হয়েছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। পরবর্তী কয়েকটি প্রান্তিক নিয়ে আমরা আশাবাদী।’’
তালুজা আরও বলেন যে, রিলায়েন্স রিটেল তাদের প্রিমিয়াম ফরম্যাটগুলিতে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছে। জিওমার্ট হাইপার-লোকাল ডেলিভারিগুলিকে বিস্তৃত স্টোর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রসারিত করেছে। রিলায়েন্সের মিডিয়া ব্যবসার রাজস্ব ডিজিটাল বিজ্ঞাপন রাজস্ব বৃদ্ধির কারণে ৬ শতাংশ বেড়েছে। মোটের ওপর মিডিয়া ব্যবসায় সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১,৮২৫ কোটি টাকার অপারেশনাল রাজস্ব হয়েছে বলে জানিয়েছে কোম্পানি।