কলকাতা: হয় রেলকর্মী, নয় আইএএস। খড়্গপুরে সরকারি কর্মচারী হিসেবেই জীবন কাটিয়ে দিতেন হয়তো। ‘হাতোড়া ত্যাগী’ আর হওয়া হত না। বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। খড়্গপুর থেকে মুম্বই। সাগরপাড়ে বসে দীর্ঘ ৮ বছরের অপেক্ষা। আর তারই ফসল আজকের অভিষেক। সেই অপেক্ষা কেবল তাঁর ছিল না, দেশের দর্শকদেরও ছিল। নিউজ১৮ বাংলার তিস্তা রায় বর্মণের সঙ্গে কথা বললেন পর্দা-ওটিটির তারকা অভিনেতা তথা মুম্বইয়ের কাস্টিং ডিরেক্টর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: ৮ বছর ধরে ছবি-সিরিজে অন্যের কাস্টিং করেছেন, এদিকে নিজে অভিনেতা হতে চাইতেন, কষ্ট হত না অডিশন নিতে?
অভিষেক: সত্যি বলতে, হত কষ্ট। অডিশন নিতে নিতে স্বপ্ন দেখতাম আরও। আর নিজের মনে মনে অভিনয়টা করতাম। ৮ বছর ধরে এভাবেই চলেছে। তখন মনে হত, আর হয়তো অভিনেতা হওয়া হবে না। সমস্ত আশার আলো নিভে গিয়েছিল। মনে হত, ঠিক আছে, বুড়ো বয়সে সুযোগ পেলে স্বপপূরণ হবে, নয়তো না।
প্রশ্ন: এরকম কোনও চরিত্র আছে, যেখানে অন্য অভিনেতাদের অডিশন নিতে নিতে নিজেকে কাস্ট করতে ইচ্ছে হয়েছে?
অভিষেক: (হেসে) ভাল প্রশ্ন। একটু ভাবতে হবে… দু’টো চরিত্রের কথা বলতে পারি। প্রথমটা, ‘গানস অ্যান্ড গুলাবস’-এ আদর্শ গৌরবের চরিত্রটা। আমরাই কাস্ট করেছিলাম। গৌরব এত ভাল করেছে যে এখন মনে হয়, খুব ভাল কাস্ট করেছি আমরা। কিন্তু ওই চরিত্রটা করার খুব ইচ্ছে ছিল আমার। আর একটি হল ‘ঘনচক্কর’। নমিত দাসের চরিত্রটা করতে চেয়েছিলাম মনে মনে। অডিশনও দিয়েছিলাম, কিন্তু বাদ দিয়ে দিয়েছিল আমায়।
প্রশ্ন: অভিনেতা হতে গিয়ে কাস্টিং ডিরেক্টর কী করে হয়ে গেলেন?
অভিষেক: অভিনেতা হওয়ারও তো কথা ছিল না আমার। বাবা চাইতেন, আমি সরকারি চাকরি করি। কিন্তু আমি অভিনেতা হতে চেয়েছিলাম ছোট থেকে। বাবা বদলির চাকরি ছিল বলে বিভিন্ন শহরে থাকতে হয়েছে। কিন্তু বাবার কাছে অত টাকা ছিল না যে আমায় মুম্বইতে পাঠাতে পারবে। অতি কষ্টে মুম্বইয়ে এসে স্ট্রাগল করা শুরু। এখনও শ্রমজীবীদেরই সমাজেরই অন্তর্ভুক্ত আমরা। এই দেশের অধিকাংশ মানুষ। ঘরে ঘরে প্রচুর টাকা নেই। এদিকে অভিনেতা হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। কিছু তো করতে হতই। অল্প অল্প করে কাস্টিংয়ের কাজ ঢুকছিল। সেটা করতে করতেই ৮ বছর চলে গেল।
প্রশ্ন: বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে অভিনেতা হওয়ার স্ট্রাগলের মধ্যে পড়লেন একা…
অভিষেক: আসলে আমার মা পাশে না দাঁড়ালে হয়তো এত দূর আসতে পারতাম না। আমার সাফল্যের পিছনে মায়ের হাত অনেকটা। বাবা যখন আমার এই স্বপ্নের বিরোধিতা করছিলেন, মা কিছু না ভেবে বিশ্বাস রেখেছিলেন আমার উপর। আর এই কারণেই আমি আজ এখানে দাঁড়িয়ে।
প্রশ্ন: আপনাদের এতদিন ধরে স্ট্রাগল করতে হচ্ছে৷ আর এদিকে তারকা-সন্তানরা যে নির্ঝঞ্ঝাটে একের পর এক কাজ পেয়ে যাচ্ছে? রাগ হয় না?
অভিষেক: আমার মামা রেলে কাজ করতেন, আমার দাদু রেলে কাজ করতেন। আমাকে বাড়িতে সবসময়ই শুনতে হত, ‘তুই রেলে চাকরি করবি’, তারপর বড় হতেই বাবা বলতে শুরু করলেন ‘আইএএস পরীক্ষায় বসবি’, কারণ তিনি সরকারি চাকুরীজীবী। তেমন ভাবেই কিন্তু স্টারকিডদের বাবা-মায়েরা চান।
প্রশ্ন: বহু সিনিয়র অভিনেতাদের অভিযোগ, আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলোয়ার দেখে কাস্টিং হয়, আপনারাও কি সেভাবে কাস্ট করেন?
অভিষেক: এটা না একদম ভুল ধারণা। আমাদের বাইরে গিয়ে গিয়ে মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে হয়। নাটক দেখতে যেতে হয়। হ্যাঁ সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়তো দু’একটা করে রিল দেখে নেওয়া হয়। ওইটুকুই। কিন্তু ক’জন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারকে অভিনেতা হিসেবে দেখা যায় পর্দায়? হয়তো অনেকে ফলোয়ার দেখে কাস্ট করে, কিন্তু সেটার ফলাফল তো খুব ভাল হয় না, আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
প্রশ্ন: কিন্তু আপনার বাবা-মা চাইলেই সেটা হত না। স্টারকিডদের ক্ষেত্রে সেটা একটু সহজ নয় কি?
অভিষেক: হ্যাঁ মানছি। কিন্তু এই ধারণাটা ভুল যে, ওদের সুযোগ পাওয়ার জন্য বাকিরা সুযোগ পাচ্ছে না। আমরা নিজেরা কত নতুন ছেলেমেয়েদের কাস্ট করেছি। লোকে ভালওবাসছে তাঁদের। সময় বদলাচ্ছে। ‘জুবিলি’তে ওয়ামিকা গাব্বিকে আমরা কাস্ট করেছি। তৃপ্তি ডিমরিকে আমরাই কাস্ট করেছি ‘বুলবুল’-এ। মুকেশ ছাবরা এনেছেন শর্বরী ওয়াগকে। ‘মুনজিয়া’তে অভয় ভর্মাকে নিয়ে এসেছি আমরা। আমি যে জন আব্রাহামের সঙ্গে ‘ভেদা’তে কাজ করছি, ভিলেন হয়েছি, সেটাও কি খুব সহজ ছিল একটা সময়?
প্রশ্ন: কেরিয়ারে সবচেয়ে ‘ডিফাইনিং মোমেন্ট’ কোনটা? অনেকে বলে, পাতাল লোকের হাতোড়া ত্যাগী, সত্যিই কি তাই?
অভিষেক: ‘স্ত্রী’ আর ‘পাতাল লোক’ দু’টোই। ‘স্ত্রী’-তে প্রথমবার ইন্ডাস্ট্রি দেখতে পেল যে নতুন ছেলে এসেছে, যে অভিনয় করতে পারে। আর ‘পাতাল লোক’ দর্শকেরা দেখতে পেল। আমি সবসময়ে বলব, দর্শকেরা আমায় জায়গা দিয়েছে।
প্রশ্ন: ওই প্রবল ভয়াবহ অভিনয়টা না করলে, মানুষকে অত ভয় না দেখাতে পারলে দর্শকেরা জায়গা দিত কি? ‘হাতোড়া ত্যাগী’র চরিত্রে আপনি অসামান্য।
অভিষেক: (হেসে) অনেক অনেক ধন্যবাদ।
প্রশ্ন: অভিনেতা হিসেবে তো সবার ভালবাসা পেয়েছেন, কিন্তু বাণিজ্যিক ছবিতে রোম্যান্স, অ্যাকশন, নাচ, গান করতে ইচ্ছে করে? হিরো হতে চান?
অভিষেক: হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ইচ্ছে হয়। বাণিজ্যিক ছবি আমার ভালও লাগে দেখতে। নাচ, গান করতে ও ইচ্ছে করে পর্দায়।
প্রশ্ন: ‘কাস্টিং বে’-র মতো সফল কাস্টিং এজেন্সি আছে আপনার। নিজেকেই তো কখনও কাস্ট করতে পারেন এই ধরনের ছবিতে।
অভিষেক: না না, বাণিজ্যিক ছবির হিরো হিরোয়িনের কাস্টিংটা পুরোটাই পরিচালক-প্রযোজকের উপর নির্ভর করে। তাঁরা না চাইলে কখনওই হবে না। আমার কেবল অপেক্ষা, আমাকে কেউ কোনওদিন এই ধরনের ছবির হিরো হিসেবে দেখবে। কোন সুযোগ কখন আসবে, আমরা কেউ জানি না। আমার কাজটা হল, অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করে যাব। আর আমার কাজটা দর্শক দেখুক, প্রযোজক দেখুক, পরিচালক দেখুক। আর দেখানোর জন্যই আমি কাজগুলো করছি। ও হ্যাঁ, এবার ‘স্ত্রী ২’-তে আমি গানও করছি, নাচ-ও করছি। হিরোর মতো নয়। চরিত্রাভিনেতার মতো। আমার এখন প্রশ্ন, পরিচালকরা কি আমাকে নিয়ে ওরকম সিনেমা করবে? নাকি তারা ভাববে, ও তো ভাল অভিনেতা, ওকে নিয়ে আমরা অভিনয়ভিত্তিক ছবি বানাব… জানি না।
প্রশ্ন: সমস্ত ইন্ডাস্ট্রিতেই নির্দিষ্ট এক ধরনের চেহারার উপর ভিত্তি করে হিরো হিরোয়িনের কাস্টিং হয়। আপনিও কি সেটার শিকার নন?
অভিষেক: হ্যাঁ এটা একটা প্রবণতা, মানছি। কিন্তু দেখো বদলটা কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছে। ওটিটি-র জন্যই কিন্তু ‘আমরা’ বড়পর্দায় আসছি। আজ বিপুল শাহর মতো পরিচালক, যিনি অমিতাভ বচ্চন, অক্ষয় কুমার, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গে কাজ করে এসেছেন এতদিন, তিনি ছবি (হিসাব) বানাচ্ছেন আমাকে, শেফালী শাহ এবং জয়দীপ আহলাওয়াতকে নিয়ে। এটা কি বড় বদলের শুরু নয়?
প্রশ্ন: অবশ্যই। কিন্ত যে ধরনের ছবির কথা বলছি, সেখানে এই বদল আসছে কি?
অভিষেক: আচ্ছা আমাকে বলুন, কোনও নতুন আমাদের মতো অভিনেতারা মসালেদার ছবিতে কাজ করলে, দর্শক দেখতে যাবেন তো? এটা কিন্তু দর্শকদের মানসিকতার উপর নির্ভর করছে। যেটা বদলের অপেক্ষায় আছি আমরা। ধীরে ধীরে হচ্ছেও। ২০১৮ সালে যখন প্রথমবার ‘স্ত্রী’ এসেছে, তখন কিন্তু খানদের ছবি বা কাপুরদের ছবি ১০০ কোটি আয় করত। সেই সময় ‘স্ত্রী’-র ওই বিপুল জনপ্রিয়তা আশা করা যায়নি। কিন্তু হয়েছে।
প্রশ্ন: এবার ‘স্ত্রী ২’-তে মানুষ আপনাকে নাচতে-গাইতে দেখবে। দেখা যাক, তাঁদের কেমন লাগে। আগের ছবির মতো এখানেও নারীবাদী দৃষ্টিকোণ, রাজনৈতিক বক্তব্য থাকবে?
অভিষেক: হ্যাঁ থাকছে। এবার তার উপর আরও একটা স্তর চাপছে। কেবল নারীদের নয়, পুরুষদেরও যে নারীবাদী হয়ে উঠতে হবে, সেটা নিয়ে বক্তব্য আছে। ‘স্ত্রী’-তে আলাদা আলাদা অ্যাডভেঞ্চার দেখতে পাওয়া যাবে। এটায় স্কন্ধকাটা ভূতকে দেখা যাবে।
প্রশ্ন: বাংলার ছেলেকে বাংলা ছবিতে কবে দেখতে পাব?
অভিষেক: আমি তো খুব চাই! কিন্তু কেউ আমায় ডাকেই না বাংলা থেকে। কেবল সৃজিতদা (সৃজিত মুখোপাধ্যায়) আমাকে একটি ছবির জন্য ডেকেছিলেন। কিন্তু অন্য একটি কাজ আগে থেকেই ওই সময়ে ছিল, তাই করা হয়নি। কিন্তু আপনার মাধ্যমে আমি সৃজিতদাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তিনিই একমাত্র বাংলা থেকে আমার কথা ভেবেছেন।
প্রশ্ন: তাই নাকি? ডাকের অভাবে বাংলায় কাজ করা হয় না? কিন্তু এত কম ডাক পড়ছে কেন এখান থেকে?
অভিষেক: আমার মনে হয় নানা ধরনের ধারণা থাকে পরিচালকদের মনে। মুম্বইয়ের অভিনেতা, টাকাপয়সা কেমন চাইবে না চাইবে… কী জানি, কারণটা জানি না। কিন্তু কেউ ডাকলে আমি ভীষণই খুশি হব। বাংলায় কাজ না করলে আমার যাত্রা সফল হবে কী করে?
প্রশ্ন: বাংলায় আপনাকে নিয়ে একটা গসিপ আছে জানেন তো?
অভিষেক: গসিপ? আমাকে নিয়ে? সেকী!
প্রশ্ন: শুনতে পাওয়া যায় আপনি এবং অভিনেত্রী অনিন্দিতা বোস প্রেমের সম্পর্কে রয়েছেন। দু’জন লিভ-ইনও করছেন।
অভিষেক: অনিন্দিতা? লিভ-ইন? এবাবা! বাংলায় এরকম রটনা আছে নাকি? হ্যাঁ আমি একবার একটি লেখা পড়েছিলাম, যেটা পড়ে মনে হয়েছিল, আমার কথা বলা হচ্ছে। আমি আর অনিন্দিতা খুব হেসেছিলাম সেটা পড়ে।
প্রশ্ন: তার মানে এই রটনা সম্পূর্ণ হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতোই?
অভিষেক: একেবারেই! আমি আর অনিন্দিতা খুব ভাল বন্ধু। কিন্তু এমনই বন্ধু যে শেষ কথা হয়েছে… (ফোন দেখে) মে মাসে, আমার জন্মদিনে উইশ করেছিল ও। দেখা হয়েছে তিন বছর আগে। মানে খুব যে যোগাযোগ থাকে, তা নয় (হেসে)। আমার ধারণা, ‘পাতাল লোক’-এ ওকে আমি কাস্ট করেছিলাম বলে এই গসিপ শুরু হয়েছে। কয়েকদিন আগে একটা ভিডিও বেরিয়েছিল, সেটা দেখলেই বোঝা যাবে, আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকি। (হেসে) সেখানে আর কোনও মহিলা নেই।