Tahsan Rahman Khan: আমার দায়বদ্ধতা শুধু আমার মেয়ে এবং শিল্পের প্রতি, সকলকে খুশি করা সম্ভব নয়: তাহসান

তাঁর সৃষ্টির ‘আলো’ কাঁটাতার চেনে না। মানে না ভূগোলের দূরত্ব। তিনি হলেন সেই সুতো, যাঁর মায়ায় জড়িয়ে দুই বাংলা। আলোকবৃত্ত থেকে  দূরে দাঁড়িয়েও গানে, অভিনয়ে ‘মোমের দেওয়াল’ ভেঙে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন একরাশ মুগ্ধতা। সেই মানুষের জীবনের মন্তাজে কোন অনুভূতিদের ভিড়? কাজ হোক বা শেষ-না-হওয়া বিতর্ক, নিউজ18 বাংলার কাছে অকপট বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় তারকা তাহসান রহমান খান।

গায়ক, অভিনেতা তাহসান থেকে পর্দার ক্রিকেটার, ওটিটি-তে হাতেখড়িতেই ঝোড়ো ব্যাটিং…

আসলে একটা বয়সের পরে তো খেলাধুলো কমে যায়। কিন্তু ‘বাজি’-তে অভিনয়ের সুযোগে অনেক অনুশীলন করতে হয়েছে। সিন শ্যুটের সময়ও ক্রিকেট খেলতে হয়েছে। অনেক দিন পর আবার খেলার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠল। সুতরাং বলাই যায় যে, পর্দার ক্রিকেটার হয়ে ওঠাটা আমার জন্য বেশ এক্সাইটিং ছিল।

প্রস্তুতি পর্বটা কেমন ছিল? ছোটবেলায় কি কখনও ক্রিকেট খেলা হয়েছে নাকি একদম শুরু থেকে শুরু করতে হল?

ছোটবেলায় স্কুলে থাকাকালীন ক্রিকেট খেলেছি। আজ থেকে ১০-১২ বছর আগে একটি সেলিব্রিটি ক্রিকেট লিগ হয়েছিল। সেখানেও একবার প্র্যাকটিস করেছিলাম। অনেক যে ক্রিকেট খেলেছি, তা নয়। কিন্তু খেলার অভ্যাসটা ছিল বলে খেলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেছি।

এত দিনে হাতে নিশ্চয়ই প্রচুর চিত্রনাট্য এসেছে। ‘বাজি’-তেই কেন ভরসা রাখলেন?

হ্যাঁ, অনেক চিত্রনাট্য পেয়েছি। কিন্তু অভিনয় থেকে যেহেতু বিরতি নিয়েছিলাম, তাই এমন কিছু খুঁজছিলাম, যেটা চ্যালেঞ্জিং হবে। ‘বাজি’র স্ক্রিপ্টটা পড়েই আমার ভাল লেগেছিল। একজন পাবলিক ফিগারের লাইফে যে কতগুলো প্রেশার পয়েন্ট থাকে, তাদের কত কিছু ভেবে যে জীবন পরিচালনা করতে হয়, সেই বিষয়গুলি এই স্ক্রিপ্টে ছিল। যা আমাকে খুব আকর্ষণ করেছে।

তার মানে যশ-খ্যাতির বিড়ম্বনাও কিছু কম নয়…

আসলে আমরা যারা অনেক মানুষের ভালবাসা পাই, তারা একটা সময়ের পর পিপল প্লিজার হয়ে যাই। সবাইকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু একটা সময়ে বুঝতে পারি, সবাইকে কখনওই একসঙ্গে খুশি করা যাবে না। চারদিকে এত চাপ, এত রকমের প্রত্যাশা যে, মানুষকে খুশি করতে চাইলে কখনওই সেই আত্মতুষ্টি পাওয়া যাবে না।

তবে আত্মতুষ্টির জন্যই কি আবীর হায়দারের মতো একটি চরিত্র বেছে নেওয়া? পর্দায় তৈরি হয়ে যাওয়া প্রেমিক সত্তাটাকে ভাঙতে চাইছিলেন?

একজন অভিনেতা হিসাবে নিজেকে নতুন ভাবে উপস্থাপনা করার একটা খিদে তো থাকেই। আবীরের চরিত্রটা পড়ে মনে হয়েছিল, আমি বেশিরভাগ যে সব প্রেমিক সত্তা ফুটিয়ে তুলেছি, তার বাইরে গিয়ে কিছু একটা করার সুযোগ আছে। আর পাশাপাশি একজন পাবলিক ফিগারের চরিত্র বলে আরও বেশি রিলেট করতে পেরেছি। আসলে কাজটা করতে গিয়ে নিজেকে ভাঙতেও পেরেছি, আবার অনেক কিছু ভিতর থেকেও এসেছে।

জনপ্রিয়তার নিরিখে ‘বাজি’ তো ইতিমধ্যেই ছক্কা হাঁকিয়েছে…

(খানিক হেসে) সিরিজ নিয়ে ভাল সাড়া পাচ্ছি। যাঁরাই কাজটি দেখছেন, প্রশংসা করছেন। আমি খুবই খুশি।

আপনার গলায় বড় একটি সমস্যা দেখা গিয়েছিল। এখন কেমন আছেন?

এটা আসলে লং টার্ম একটা এইলমেন্ট। এই ঝামেলাটা হয়তো ঠিক হবে কিন্তু একটু সময় লাগবে। তবে গান গাইতে পারছি এবং কনসার্ট করতে পারছি। এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। গান গাইতে পারব না, এমন দুঃসংবাদ যেন কখনও না দিতে হয় সেই প্রার্থনাই সকলকে করতে বলেছিলাম।

কয়েকদিন আগেই সতীর্থদের সঙ্গে ‘ব্ল্যাক’-এর কনসার্ট করলেন। নস্টালজিক লাগল?

ভীষণ ভীষণ নস্টালজিক ছিল। আমি খুবই খুশি যে আমরা এই কনসার্টটা করেছি। (গলায় উচ্ছ্বাস স্পষ্ট)

আপনার গান কিন্তু প্রচুর মানুষের মন খারাপের ওষুধ…

আমি তো ছোটবেলা থেকে গান শিখেছি। সাধনা করেছি। কিন্তু এটা আসলে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটা ওষুধ, যেটা হয়ত কিছু মানুষের কাজে লাগছে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিগুলির মধ্যে এটিও একটা। যে আমার লেখা, সুর করা গান মানুষ হয়ত মনের খোরাক হিসাবে নিয়ে বেঁচে আছে।

আপনার কাছে নিজের কোন সত্তাটা বেশি প্রিয়? গায়ক না অভিনেতা?

ছোটবেলা থেকে যেহেতু গান শিখেছি, তাই গায়ক, গীতিকার, সুরকার হিসাবেই নিজেকে দেখি। অভিনয়টা শখে করা। কিন্তু অভিনয়ের প্রতিও একটা প্রেম জেগেছে। সেটা নিয়ে একটু পড়াশোনাও করেছি দেশের বাইরে। নিজেকে হয়ত গানের মানুষই ভাবি। কিন্তু অভিনয়টাও এখন একটা প্রেমের জায়গা করে নিয়েছে।

গান, অভিনয়ের পাশাপাশি এক সময়ে শিক্ষকতাও করেছেন…

এতগুলো দিক সামলাতে কষ্ট হত বলে অনেক বছর হল শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছি। আবার বুড়ো হয়ে গেলে হয়ত শিক্ষকতায়  ফিরে যেতে পারি।

আপনার বই ‘অনুভূতির অভিধান’-এ জীবনের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু সাফল্য-ব্যর্থতার মতো বিষয়গুলিকে কি কখনও আলাদা করে ভাবায়?

মানুষ হিসাবে আমরা যখন বড় হতে থাকি, তখন শেখানো হয় যে অর্থ, বিত্ত, যশ, খ্যাতি, ক্ষমতার মতো বিষয়গুলিই সমাজের চোখে সাফল্য। আমিও সামাজিক জীব হিসাবে সে ভাবেই বড় হয়েছি। এবং সেই জিনিসগুলির পিছনেই ছুটেছিলাম। কিন্তু যতটুকু প্রাপ্তি এসেছে, সেগুলির আস্বাদ নেওয়ার পরে মনে হয়েছে, সাফল্য-ব্যর্থতাকে আসলে মানসিক প্রশান্তির মাপকাঠিতে দেখলে ভাল হয়। আমার সেই মানসিক প্রশান্তি আছে কি না এবং মানুষের জীবনে তা এনে দিতে পারছি কি না, এখন সেই নিরিখেই সাফল্য এবং ব্যর্থতাকে মাপার চেষ্টা করি।

বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সিনেমা-ওটিটির ক্ষেত্রে একটা নব তরঙ্গ দেখা দিয়েছে। ইন্ডাস্টির অংশ হিসাবে গর্ব হয়?

এটা আসলে আমাদের সামগ্রিক একটা সাফল্য। অনেকগুলো ক্ষেত্রের মানুষ বুঝতে পেরেছেন যে এই দেশে মেধাবী মানুষ আছেন এবং তাঁদের এক হতে হবে। আমাদের দেশের মানুষ মেধাবীদের কাজ দেখতে আগ্রহী ছিলেন সব সময়। সুতরাং ভাল একটি জায়গা তৈরি হয়েছে। আমি খুবই খুশি এবং চাই এই নিউ ওয়েভটা চলুক। দেশ এবং দেশের বাইরের সব জায়গাতেই এই নিউ ওয়েভটা সমাদৃত হচ্ছে।

তা হলে একশোর বেশি নাটকে অভিনয়ের পর একটি ছবিতেই থামলেন কেন?

সবার জায়গা তো সব জায়গায় না। যাঁরা আমার অনুরাগী, দর্শক, আমি তাঁদের জন্য কাজ করি। তাঁরা আমাকে যে মাধ্যমে দেখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন, আমি সেখানেই কাজ করব। কখনও যদি ভাল চিত্রনাট্য পাই, ছবি করার কথা ভাবব। আপাতত ওটিটি-তে কাজ করলাম। ফের হয়ত সেখানেই কাজ করব।

পর্দায় তো হল, বাস্তবে কখনও কোনও ‘বাজি’ রেখেছেন?

(মৃদু হেসে) ‘বাজি’-তে অভিনয় করাটাই তো সবচেয়ে বড় বাজি ছিল!

মানে?

দেখুন, তারকা হিসাবে আমরা প্রচুর নেতিবাচকতার সম্মুখীন হই। হাজার-কোটি মানুষ যেমন আমাদের ভালবাসেন, তেমন অনেকে অপছন্দও করেন। ওত পেতে বসে থাকেন যে কখন খারাপ কথা বলবেন, খুঁত ধরবেন। আমাদের নিয়ে মানুষ অনেক সময় অনেক রকম খারাপ কথা বলা হয়। সেটা কষ্টের। কিন্তু তার থেকেও বেশি কষ্টের যে, একদিন আমার মেয়ে হয়ত বড় হয়ে সেগুলো দেখবে। আমার মেয়ে এখন যে বয়সে দাঁড়িয়ে, এটা নিয়ে আমি অনেক ভাবি। বোঝার চেষ্টা করি এই নেতিবাচকতাটা কী ভাবে কমানো যায়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করি বলেই হয়ত এরকম একটা চিত্রনাট্য বেছে নিয়েছি। যেখানে একজন পাবলিক ফিগারের জীবনের ওঠানামাগুলো তার সন্তানের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে সে ভাবছে। গল্পের এই একটা জায়গা আমাকে ভীষণ ভাবিয়েছে।

সব শেষে প্রশ্ন, কলকাতায় কবে আসবেন? সকলে তো পথ চেয়ে বসে…

ভারতে কখনও যাওয়া হয়নি। এটা আমার দুর্ভাগ্য। আমি শুনেছি, কলকাতার মানুষ আমার গান ভালবাসে। কিন্তু কোনও কারণে আমার ওখানে কোনও কনসার্ট করা হয়নি। সেই সুযোগ যদি হয় নিশ্চয়ই আসব। প্রচণ্ড ব্যস্ততার কারণে ঘুরতে গেলেও অনেক দূরে যাওয়া হয়। ভারতে যাওয়া হয় না। তবে সেখানে যাওয়া পরিকল্পনা আছে। তাই কখনও না কখনও নিশ্চয়ই যাব।

গানে গানেই কলকাতার সঙ্গে পরিচয়। আজও শহরে পা রাখা হয়নি তাঁর। এপার বাংলায় আসার কথা শুনিয়েই ফের কাজে ডুব গায়ক-নায়কের…