প্রতীকী ছবি৷

Crime news: গণধর্ষণে অন্তঃসত্ত্বা, ফিরে এল পরিত্যক্ত সন্তান! তিরিশ বছর পর বিচার পেলেন মা

লখনউ: গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১২ বছর বয়সি এক শিশুকন্যা৷ যৌন নির্যাতনের জেরে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল সে৷ এক শিশুপুত্রের জন্মও দেয় ওই নির্যাতিতা৷ কিন্তু বাড়ির মেয়ের সামাজিক সম্মান এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেই সদ্যোজাতকে পরিত্যাগ করেছিল ওই নির্যাতিতার পরিবার৷

জীবনের এই দুঃস্বপ্নের অধ্যায় অবশ্য ওই নির্যাতিতার পিছু ছাড়েনি৷ বিয়ে হলেও অতীতের এই ঘটনা আজীবন তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে৷ কিন্তু এর পর যা ঘটল, তা হয়তো বাস্তব জীবনে নয়, সিনেমার গল্পেই ঘটা সম্ভব৷ তিরিশ বছর আগে যে সন্তানকে ওই নির্যাতিতা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই সন্তানই নিজের মাকে খুঁজে বের করেন৷ শুধু তাই নয়, যারা ওই নির্যাতিতার উপরে অত্যাচার করেছিল,তাদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করার জন্য নিজের মাকে বুঝিয়ে রাজিও করিয়ে ফেলে ওই যুবক৷ শেষ পর্যন্ত ওই যুবকের ডিএনএ টেস্ট করিয়ে তাঁর মাকে ধর্ষণে দুই অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে দশ বছরের কারাদণ্ডের শাস্তি দিয়েছে আদালত৷

শুনতে অবিশ্বাস্য ঠেকলেও এমনই ঘটনা ঘটেছে উত্তর প্রদেশের হরদই জেলায়৷ ন্যায় বিচারের আশায় কীভাবে তিরিশ বছর ধরে তাঁরা লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন, নিউজ ১৮-এর কাছে সেই কাহিনিই তুলে ধরেছেন ওই নির্যাতিতা এবং তাঁর সন্তান৷

ওই নির্যাতিতার জন্ম হয়েছিল হারদই জেলারই এক প্রত্যন্ত গ্রামে৷ ওই নির্যাতিতারা পাঁচ ভাই বোন৷ নির্যাতিতার বাবা ছিলেন সামান্য কৃষি শ্রমিক৷ অনটনের সংসারে না রেখে ওই নির্যাতিতাকে শাহজানপুরে দিদির শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেয় তাঁর পরিবার৷

ঘটনার সূত্রপাত শাহজাহানপুরে

নির্য়াতিতার কথায়, ১৯৯৩ সালে তিনি শাহজানপুরে তাঁর দিদি জামাইবাবুর কাছে চলে আসেন৷ প্রথম দিকে নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ নিয়ে যথেষ্টই উত্তেজিত ছিলেন তিনি৷ কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর আনন্দ আতঙ্কে বদলে যায়৷ কারণ ওই এলাকারই কিছু যুবক তাঁর পিছু নিতে শুরু করে৷ বিষয়টি প্রথমে নিজের দিদি-জামাইবাবুকে জানান ওই নির্যাতিতা৷ আস্তে আস্তে স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দেন তিনি৷ ওই দুর্বৃত্তরা এর পর থেকে ওই নির্যাতিতার দিদির বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়েও থাকতে শুরু করে৷ তারা জেনে গিয়েছিল, ওই নির্যাতিতার জামাইবাবু বন দফতরে চাকরি করতেন এবং বাড়িতে থাকতেন না৷ তাঁর দিদিও পেশায় স্কুল শিক্ষিকা হওয়ায় বাড়ির বাইরে থাকতেন৷ সেই সুযোগেই একদিন জোর করে বাড়িতে ঢুকে নির্যাতিতার উপরে দু জন অত্যাচার চালায়৷ যাওয়ার সময় তারা হুশিয়ারি দিয়ে যায়, কাউকে কিছু জানালে তাঁর দিদি জামাইবাবুকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে৷

ওই নির্যাতিতার কথায়, ‘আমি তখন বুঝতেও পারিনি যে কী ঘটল৷ গোটা ঘটনাটিকে দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে চেয়েছিলাম৷ কাউকে কিছু জানাইনি৷ কিন্তু তখনও বুঝিনি যে এই ঘটনা সারা জীবনে আমাকে তাড়া করে বেড়াবে৷

আরও পড়ুন: অমেঠিতে হারায় সমাজমাধ্যমে অপদস্থ স্মৃতি, লাগাম টানতে আসরে রাহুল! কী লিখলেন বিরোধী দলনেতা?

এর পর থেকে মাঝেমধ্যেই ওই নির্যাতিতার দিদির বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁর উপরে চড়াও হত ওই অভিযুক্তরা৷ নিয়মিত ওই যৌন নির্যাতনের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন ওই নির্যাতিতা৷ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর দিদি তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে এ কথা জানা যায়৷ ওই নির্যাতিতার কথায়, আমি তখনও জানতাম না কী হয়েছে৷ আমার দিদি জামাইবাবু আমাকে মারধর করতে শুরু করে৷ তখন আমি আমার দিদি এবং মাকে গোটা ঘটনা খুলে বলি৷ এর পর যে দুই অভিযুক্ত আমার উপরে অত্যাচার চালিয়েছিল, তাদের বাড়িতেও যান আমার দিদি জামাইবাবু৷ কিন্তু তারা উল্টে আমার দিদি-জামাইবাবুকেই মেরে ফেলার হুমকি দেয়৷ এর পর আমাকে অন্য একটি শহরে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ওই সময় আমার গর্ভপাত সম্ভব ছিল না৷ আমি একটি শিশুপুত্রের জন্ম দিই৷ কিন্তু তার মুখ আমাকে দেখতে দেওয়া হয়নি৷ আমার মা আমাকে বলেছিল, এ সম্পর্কে কাউকে কিছু বললে গোটা পরিবার আত্মহত্যা করবে৷’

নির্যাতিতার আজীবন হেনস্থা

এর পর ওই নির্যাতিতাকে হারদইতে তাঁর গ্রামের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়৷ কিন্তু সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তাঁর শারীরিক পরিবর্তন দেখে অনেকেই দুইয়ে দুইয়ে চার করে ফেলেন৷ পাড়া প্রতিবেশীদের কটূ কথা থেকে বাঁচতে হারদই গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় নির্যাতিতার পরিবার৷ এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঠাঁই হয় নির্যাতিতার৷ শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালে বারাণসীতে তাঁর বিয়ে হয়৷

বিয়ের পর সব ঠিকঠাকই চলছিল৷ আবারও একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন তিনি৷ কিন্তু কোনওভাবে ওই নির্যাতিতার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁর অতীত জীবনের কথা জেনে যায়৷ এর পরেই ওই নির্যাতিতাকে নিজের সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন তাঁর স্বামী৷ এমন কি, নির্যাতিতার পাশে দাঁড়ানোয় তাঁর জামাইবাবুও দিদিকে পরিত্যাগ করেন৷

হারিয়ে যাওয়া সন্তানের ফিরে আসা

২০০৭ সালে ওই মহিলা তাঁর দ্বিতীয় সন্তানকে নিয়ে লখনৌতে চলে আসেন৷ সেখানেই একটি হস্টেলে থাকতে শুরু করেন তিনি৷ একটি বেসরকারি চাকরিও করতে শুরু করেন৷ কিন্তু নানা বাধা বিপত্তি আসতে থাকে তাঁদের জীবনে৷ ওই নির্যাতিতা বলেন, ‘একদিন হঠাৎই একটি ছেলে এসে আমার সামনে দাঁড়ায়৷ ওই ছেলেটি দাবি করে, আমার পরিবার যাকে পরিত্যাগ করে দিয়েছিল, ও সেই সন্তান৷ এ কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই৷ কীভাবে ও আমাকে খুঁজে বের করল আমি জানি না, কিন্তু ও আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে৷’

নতুন লড়াই শুরু নির্যাতিতার

নিজের দুই সন্তানেকে নিয়েই এর পর দিন গুজরান শুরু করেন ওই নির্যাতিতা৷ কিন্তু মাঝেমধ্যেই তাঁর প্রথম সন্তান নির্যাতিতার কাছে নিজের পিতৃ পরিচয় জানতে চাইত৷ কিন্তু সেই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যেতেন ওই নির্যাতিতা৷ শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালে ওই নির্যাতিতার প্রথম সন্তান হুমকি দেয়, পিতৃপরিচয় না জানালে নিজেকে শেষ করে দেবে সে৷ এর পরই গোটা ঘটনা ছেলের সামনে তুলে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন ওই নির্যাতিতা৷
তাঁর উপরে যারা অত্যাচার চালিয়েছিল তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য নিজের মাকে বোঝাতে শুরু করেন ওই যুবক৷ কোনওক্রমে পয়সা জমিয়ে শাহজানপুরে গিয়ে অভিযুক্তদের খোঁজ করতে শুরু করেন তাঁরা৷ কিন্তু দোষীদের খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল৷ কারণ অভিযুক্তদের মধ্যে রাজি ভাই বলে একজনের নামই শুধুমাত্র সম্বল ছিল ওই নির্যাতিতা এবং তাঁর ছেলের৷ স্থানীয় পুলিশও তাঁদের সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ৷ শেষ পর্যন্ত এলাকার বিভিন্ন দোকানে এবং কয়েকজন বাাসিন্দার কাছে নিজেদের নম্বর দিয়ে আসেন ওই মহিলা এবং তাঁর ছেলে৷ নিজেদেরকে দুবাই থেকে আসা রাজি ভাইয়ের আত্মীয় বলে পরিচয় দেয় তাঁরা৷ রাজি ভাইয়ের সাক্ষাৎ পেলে ওই নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়৷

কীভাবে খোঁজ মিলল ধর্ষকদের

প্রায় দু বছর পর সত্যিই একদিন সেই রাজি ভাই ওই নম্বরে ফোন করে৷ নির্যাতিতা আত্মীয় সেজে রাজি ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন৷ এর পর রাজি ভাইয়ের সেই ফোন নম্বর পুলিশকে দেওয়া হয়৷ শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল দুই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে পুলিশ৷ জানা যায়, গণধর্ষণে অভিযুক্ত দুজন আসলে সম্পর্কে ভাই হয়৷ তাদের নাম মহম্মদ রাজি এবং গুড্ডু হাসান৷ ২০২২ সালের অগাস্ট মাসে দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে উত্তর প্রদেশ পুলিশ৷ নাকি হাসান নামে তৃতীয় অভিযুক্তকে পরে হায়দ্রাবাদ থেকে গ্রেফতার করা হয়৷

ওই মহিলার আইনজীবী মুথার খান জানিয়েছেন, আদালতে শুনানি পর্বে অভিযুক্তদের আইনজীবী সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাব, মহিলার প্রসব করানো চিকিৎসককে খুঁজে না পাওয়ার মতো যুক্তি দেন৷ আবার নির্যাতিতার সঙ্গে অভিযুক্তদের পারস্পরিক সম্মতিতেই তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল৷ যদিও এই সমস্ত যুক্তি খণ্ডন করে নিজের অবস্থানে অনড় থাকেন নির্যাতিতার প্রথম সন্তান৷

ডিএনএ টেস্টে মিলল প্রমাণ

শেষ পর্যন্ত নির্যাতিতার সন্তান এবং অভিযুক্তদের ডিএনএ টেস্ট করানোর নির্দেশ দেয় আদালত৷ পরীক্ষার ফল ইতিবাচক আসে৷ ডিএনএ টেস্টের ফলাফলে রাজি নামে ওই ব্যক্তিকেই ওই যুবকের বাবা হিসেবে দাবি করা হয়৷

ডিএনএ পরীক্ষার ফল দেখে মহম্মদ রাজি এবং হাসান নাকিকে দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত৷ পুলিশ জানিয়েছে, অপরাধ ঘটার সময় অভিযুক্তদের বয়স ছিল যথাক্রমে ২৫ এবং ২২ বছর৷ সেখানে নির্যাতিতার বয়স ছিল ১২ বছর৷ বর্তমানে দুই অভিযুক্তের বয়স এখন ৫৫ এবং ৫২ বছর৷ নির্য়াতিতার বয়স এখন ৪২৷ অন্যদিকে তাঁর সন্তানের বয়স এখন ৩০ বছর৷

আদালতের রায়ের পর ওই নির্যাতিতা বলেন, সারা জীবন এই হেনস্থার পর সর্বশক্তিমানের উপরে আমার বিশেষ ভরসা নেই৷ কিন্তু কখনও সুযোগ পেলে ভগবানকে আমি প্রশ্ন, ‘অন্য কারও অপরাধের জন্য আমাকে এবং আমার সন্তানদের কেন সারাজীবন ধরে ভুগতে হল?’