কলকাতা: সব উৎসবের একটা নিজস্ব কালার কোড থাকে। দুর্গাপুজোরও আছে বইকি। সেটা লাল আর সাদা- এ ব্যাপারে দ্বিরুক্তি করবেন না কেউই। মজার ব্যাপার, এবার বালিগঞ্জের ডোভার টেরেসের মহানির্বাণ রোডে শহরের সুস্বাদের অন্যতম জনপ্রিয় পরিচায়ক সপ্তপদী-র যে নতুন শাখা খুলল, সেখানেও সেই লাল আর সাদার ছোঁয়া।
অনেক দূর থেকেও চোখে পড়বে সাদা দেওয়ালে উজ্জ্বল লালে বড় বড় করে লেখা- সপ্তপদী বাঙালি রেস্তোরাঁ। লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একদা পথে নেমেছিলেন কলকাতার দোকানের নাম বাংলায় লেখা হোক এই দাবিতে, আজ বেঁচে থাকলে বাংলা হরফে সপ্তপদী-র নতুন শাখার নাম দেখে নিশ্চয়ই আহ্লাদিত হতেন। যাঁরা ঢুঁ মারবেন, তাঁরাও যে মজবেন বাংলা আর বাঙালি ঐতিহ্যের ভালবাসায়, এ হলফ করে বলা যায়।
তবে, ওই লাল আর সাদার যুগলবন্দি, যা এবারের দুর্গাপুজোতেও চোখে পড়বে শাড়ি, পাঞ্জাবি, ধুতির জমিতে, সেটাই উঠে আসা কি নিছক সমাপতন? একেবারেই না। বলছেন খোদ সপ্তপদী-র প্রতিষ্ঠাতা ডাকসাইটে শেফ রঞ্জন বিশ্বাস। ‘‘যে রাজ্যে জন্ম নিয়েছি, তার রন্ধনশৈলীর সঙ্গে আমার যে রোম্যান্স, তাকেই টেবিলে পৌঁছে দিতে চাই। আমার শহরের অপূর্ব খাবার ভারতীয় নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সূত্রে একটাই জিনিস শিখেছি- সবার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক টুকরো কলকাতা। তাই জোর দিয়েছি বাঙালিয়ানায়। আর এটা তো সত্যিই যে যে বছরের এই সময়টায়, সে পোশাকে হোক বা খাদ্যাভ্যাসে, সকলেই ধ্রুপদী হয়ে উঠতে চান। আর কে না জানেন, বাঙালি তার ভোজনরসিকতার সূত্রে বিশ্ববিদিত, আমরা সবাই জীবনের বিশেষ বিশেষ দিনগুলো উদযাপন করি সুস্বাদু বাঙালি ব্যঞ্জনে’’, বলছেন তিনি।
সপ্তপদীর সব শাখাতেই তাই বাঙালি সংস্কৃতির সগৌরব উপস্থিতি। কাঠের পুতুল, হাতপাখা পেরিয়ে এসে এবার পুজোর মুখে খুলে যাওয়া নতুন শাখাতে সেই উদযাপন রূপ পেয়েছে প্রবাদপ্রতিম বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক অজয় করের সমনামী ছবিতে। ঢোকার মুখেই সাদা দেওয়াল জুড়ে রিনা ব্রাউন আর কৃষ্ণেন্দুর রোম্যান্সের ঝলক। ভিতরেও রয়েছে সপ্তপদী ছবির স্টিল, সুচিত্রা সেনের মুক্তাঝরানো হাসি আর উত্তম কুমারের আবেগময় চাহনি। এই ভাবেই যে পুজোর দিনে ছেলেটি তাকায়, মেয়েটি সলজ্জ হাসিতে লাল হয়, ভাবে এই পথ শেষ না হোক, নতুন করে বলে দিতে হয় না। সঙ্গে রয়েছে সাদা-সবুজ থিমে দেওয়াল জোড়া বাঁধানো ফ্রেমে কালীঘাট পটের আদলে জীবনযাপনের ঝলক, দেওয়ালের বর্ডার ঘিরে মেদিনীপুর পটচিত্রের বহমান কোলাজ। দুর্গা পট, মহানায়কের মূর্তি- পুজো পরিক্রমার এও এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
আর খাওয়াদাওয়া? ওটা বাদ দিলে চলে কী করে! পুজোর কয়েকদিন বাঙালি থালি আর বুফে দুইয়েরই আয়োজন রেখেছে সপ্তপদী। সেই সুবিশাল আয়োজনে এবার চোখ রাখা যাক।
পুজো স্পেশ্যাল থালি, ৮৮৯ টাকা (অতিরিক্ত কর প্রযোজ্য)-
স্টার্টার
মাছের টিকলি, তিল লঙ্কা মুর্গি, রাঙা আলুর বাটার কাটলেট, ঝুরি আলুভাজা, ছানা কিসমিস ক্র্যাকল, লিচু লঙ্কার সরবত
মেইন কোর্স
সাদাভাত বা পোলাও (যাঁর যেটা পছন্দ), মুগ ডাল, স্যালাড, পটল ফুলকপির শুকতানি, বাদামি কাঁচালঙ্কার আলুর দম, ভেটকি পাতুরি, চিংড়ি মালাইকারি, মটন কষা বা চিকেন কষা (যাঁর যেটা পছন্দ)
ডেজার্ট
চাটনি, পাঁপড়, রসগোল্লা, মিহিদানা, ল্যাংচা, সেই দিনে তৈরি কোনও এক পায়েস
পুজো স্পেশ্যাল বুফে, ১১৯৯ টাকা (অতিরিক্ত কর প্রযোজ্য)-
পানীয়
লিচু লঙ্কার সরবরত, কাঁচা আমের সরবত, দই লেবুর ঘোল
স্টার্টার
মাছের টিকলি, তিল লঙ্কা মুর্গি, রাঙা আলুর বাটার কাটলেট, ঝুরি আলুভাজা, ছানা কিসমিস ক্র্যাকল, ফ্রেশ গ্রিন স্যালাড এবং শেফের পছন্দের স্যালাড
মেইন কোর্স
সাদাভাত, নবরতন দম পোলাও, পটল ফুলকপির শুকতানি, বাদামি কাঁচালঙ্কার আলুর দম, হিং কড়াইশুটির ধোঁকার ডালনা, পনির মেথি মাখন, ভাপা ভেটকি সরষে, চিংড়ি মালাইকারি, কাঁচালঙ্কা ধনেপাতা মুর্গি, মটন সিপাহি
জেনে রাখা ভাল, সপ্তপদী-র সল্ট লেক শাখায় আয়োজন শুধু বুফের, মহানির্বাণ রোড আর বেহালায় বুফে-থালি দুই মিলবে, বাঘাযতীন শাখায় আবার বুফের পাশাপাশি থাকছে আ লা কার্টের সুযোগও। মা-ঠাকুমার হাতের রান্নার স্মৃতিবিজড়িত স্বাদ এভাবেই এবার পুজোয় ফিরে আসতে চলেছে সপ্তপদী-র সাজিয়ে দেওয়া পাতে। সঙ্গে নতুন স্মৃতিও তৈরি হবে নিশ্চয়ই। পায়চারি থেকে সপ্তপদীর যাত্রাপথ অতিক্রম করবেন যে যুগলেরা, এখানে এলে পুজোর স্মৃতি তাঁদের মনে থাকবে আজীবন।
শোনা যায়, যাঁর বই থেকে ছবিটা তৈরি, যে নামে রেস্তোরাঁরও নামকরণ, তার লেখক না কি সুচিত্রা-উত্তম অভিনীত ছবিটা দেখে খুশি হননি, গল্প একটু বদলে দেওয়া হয়েছিল বলে। সে যা-ই হোক, লাভপুরের খাদ্যরসিক জমিদারবাড়ির সন্তান তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে এই সপ্তপদী দেখে যে খুশি হতেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না!