আস্ত একটা সিনেমা যেন। বাবা চলে যাওয়ার পর অসহায় মা ও ছেলের দায়িত্ব নেন ঠাকুরমা। সেই ছেলে বড় হয়ে খুব ছোট একটা চাকরি নিয়ে ঢোকেন পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে, তারপর এক সময়ে সেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের পদে বসেন নিজের মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে। তারপরের টুকু গল্পে হয়। তিনি তা বাস্তবে করে দেখিয়েছেন। ২১ বছরের ‘মিশনে’ পৃথিবীর ৬টি মহাদেশের ১০০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে দেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা। তিনি, রতন টাটা। মহাষষ্ঠীর রাতে আছড়ে পড়ল সেই খবর। রতন টাটা প্রয়াত। ঝুপ করে যেন নেমে গেল অন্ধকার। ভারতীয় শিল্প জগত তো বটেই, গোটা দেশেরই যেন মন খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ একটা মুহূর্তেই। কত মানুষের অনুপ্রেরণার যে আজ চলে যাওয়ার দিন।
রতন টাটা নেহাত শিল্পপতি বা টাটা গ্রুপের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক আদর্শের নাম। যিনি কোটি-কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন। কর্পোরেট চাকচিক্য নয়, তাঁকে একেবারে নিজেদের একজন ভেবে এসেছেন আমজনতা। নিজের চোখে না দেখার পরও আদর্শ হয়ে থেকেছেন তিনি। রাস্তার গরীব-গুর্বো থেকে পথকুকুর, রতন টাটা ‘বন্ধু’ ছিলেন সকলের।
শতাধিক বছর আগে টাটা গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা করেন রতনের প্রপিতামহ। ১৯৯১ সালে সেই গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হন তিনি। তখন মূলত অটোমোবাইল এবং ইস্পাতশিল্প ক্ষেত্রে ছড়িয়ে ছিল টাটা গোষ্ঠীর ব্যবসা। ১৯৯৬ সালে টাটা টেলিসার্ভিস শুরু করেন রতন টাটা। ২০০২ সালে শুরু করেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ‘টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিস’। ২০১২ সালে টাটা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার সরাসরি দায়িত্ব থেকে সরে সাম্মানিক পদে বসেন রতন। কিন্তু ততদিনে টাটা মানেই রতন টাটা।
১৯৩৭ সালে তদানীন্তন বম্বেতে রতনের জন্ম। তাঁর বাবা নাভাল হরমুসজি টাটাকে দত্তক নিয়েছিল টাটা পরিবার। রতন টাটার বয়স যখন প্রায় দশ, সেই সময়ই তাঁর বাবা-মায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। এরপরই ঠাকুরমা নাভাজিবাই টাটা তাঁর দেখাশোনার ভার নেন। আইনানুগ ভাবে দত্তক নেন রতনকে।
আরও পড়ুন: প্রয়াত রতন টাটা! ভারতীয় শিল্পের মহীরুহ পতন, গভীর রাতের দুঃসংবাদে শোকবার্তা মোদি-মমতা-রাহুলদের
মুম্বইয়ের ক্যাম্পিয়ন স্কুলে ভর্তি হন রতন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই পড়াশোনা তাঁর। এরপর মুম্বইয়েরই ক্যাথিড্রাল অ্যান্ড জন কনন স্কুলে রতন টাটার পড়াশোনা। সিমলার বিশপ কটন স্কুল এবং আমেরিকার নিউ ইয়র্কের রিভারডেল কান্ট্রি স্কুলেও পড়াশোনা করেছেন তিনি। ১৯৫৫ সালে রতন গ্র্যাজুয়েট হন রিভারডেল কান্ট্রি স্কুল থেকে। ১৯৫৯-এ কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। আমেরিকার জোনস অ্যান্ড ইমনস নামে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কিছুদিন কাজও করেন তিনি।
১৯৬১ সালে তিনি টাটা গ্রুপে টাটা স্টিলের কর্মচারী হিসেবে রতন টাটার ‘আসল’ কর্মজীবনের শুরু। শেষমেশ ১৯৯১ সালে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হয়ে তিনি টাটা গ্রুপের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনেছিলেন। ১৯৯১ সালে জেআরডি টাটা রতন টাটার মেধা পরিশ্রম ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির মূল্য দিতেই টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে বসান তাঁকে।
২০০৮ সালে মুম্বই তাজ হোটেলে জঙ্গি হামলায় বহু পরিবার তাঁদের স্বজন হারিয়ে যখন চোখের জল ফেলছিলেন, রতন টাটা পৌঁছে গিয়েছিলেন সেই মানুষগুলোর পাশে। এমনকি হোটেলের কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজে উপস্থিত থেকে সাহায্য করেছিলেন তিনি। ২০০০ সালে পদ্মভূষণ এবং ২০০৮ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত হন তিনি।
রতন টাটা শুধু শিল্পপতিই নন, তিনি একজন সমাজসেবী, একজন দূরদর্শী মানুষ। মানুষের পাশে যেমন তিনি ছিলেন, তেমনই নিজের পেশা, ব্যবসাকেও যেন এক নতুন উদ্যম দিয়েছিলেন, যা গোটা দেশের শিল্পপতি, এমনকী অতি সাধারণ মানুষকেও অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গিয়েছে, যাবে বহুকাল। রতন টাটা আসলে একটা সংকল্পের নাম। জেদ আর মানুষের কল্যাণকামী মানসিকতা থাকলে বিশ্ব জয় করা সম্ভব, এমনটাই বোধহয় বুঝিয়েছিলেন ‘টাটা’। রতন টাটা যেন এক শিল্পী, যিনি বহু মানুষের জন্য ক্যানভাস ভরিয়েছিলেন রঙে।
ব্যক্তিগত জীবনেও রতন ছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ। অকৃতদার রতন তাঁর পদ ও মর্যাদার তুলনায় নিরাভরণ জীবনই যাপন করতেন। যা তাঁকে শেষদিন পর্যন্ত এক ব্যতিক্রমী চরিত্রের তকমাই দিয়ে গেল। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে একজন দশটা-পাঁচটার মধ্যবিত্ত, আজ শোকের জ্ঞাপন সকলের। শুরু থেকে শেষ-রতন টাটা এক বাস্তবের মহীরুহ। আস্ত একটা সিনেমাও যেন।