‘শ্রী’ দিয়ে নাম শুরু, আবার দক্ষিণী, এমন নায়িকার কথা বললেই আমাদের সবার আগে চোখের সামনে শ্রীদেবীর মুখ ভেসে উঠবে। সেটাই স্বাভাবিক। তবে, দক্ষিণের আরেক নায়িকাও রয়েছেন, যাঁর নামও ওই ‘শ্রী’ দিয়েই শুরু। আশ্চর্যের বিষয় এই যে শ্রীদেবীর মতো তিনিও কেরিয়ার শুরু করেছেন বেশ অল্প বয়সে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বার বার হোঁচট খেয়েছেন দুই নায়িকাই।
দুই ‘শ্রী’-ই দিয়েছেন একের পর এক হিট ছবিও। তফাত কেবল এই যে শ্রীদেবীর স্বামীভাগ্য ভাল হলেও এঁর ক্ষেত্রে তা হয়নি। এই নায়িকার নাম শ্রীবিদ্যা। বলিউডের ছবিই যাঁরা মূলত দেখেন, তাঁরা একে চিনবেন না। কিন্তু শ্রীবিদ্যা আজও দক্ষিণী ছবির জগতে কিংবদন্তি। জীবনসংগ্রাম, অভিনয়প্রতিভা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক- সবই ফেরে ভক্তদের মুখে মুখে। তাঁর জীবন ছায়াছবির চিত্রনাট্যের নাটকীয়তাকেও হার মানানোর ক্ষমতা রাখে।
বিখ্যাত কর্ণাটকি সঙ্গীতশিল্পী এম এল বসন্তকুমারী এবং দক্ষিণী ছবির জনপ্রিয় কৌতূকাভিনেতা কৃষ্ণমূর্তির সংসারে ১৯৫৩ সালের ২৪ জুলাই শ্রীবিদ্যার জন্ম হয়। ছোট থেকেই জীবন ছিল সংগ্রামে পূর্ণ। তাঁর জন্মের বছরেই দুর্ঘটনায় কৃষ্ণমূর্তি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। সংসারের ভার একা এম এল বসন্তকুমারীর পক্ষে চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে মাত্র ১৪ বছর বয়সে সংসারের সুরাহায় দক্ষিণী ছবির জগতে পা রাখেন শ্রীবিদ্যা। কে বালাচন্দ্রের পরিচালনায় অপূর্ব রাগাঙ্গল ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন তিনি। প্রথম ছবিতেই স্ক্রিন শেয়ার করেন রজনীকান্ত এবং কমল হাসানের মতো তারকা অভিনেতাদের সঙ্গে। ছবিটি সুপারহিট হয়, সবার নজর কেড়ে নেন নায়িকা।
বিশেষ করে কমল হাসানের সঙ্গে তাঁর জুটি এর পর দক্ষিণী ছবির জগতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রুপোলি পর্দার রোম্যান্স কখন যে বাস্তবেও ধরা দেয়, বুঝতে পারেননি দুজনের কেউই। যখন বুঝলেন, একসঙ্গে ঘর বাঁধার সিদ্ধান্ত নিলেন। বাধা এল শ্রীবিদ্যার পরিবার থেকেই। কমল হাসান তখনও প্রথম সারির নায়ক হন, কাজেই বিয়ে পরিবার মেনে নিতে চাইল না। সম্পর্কে এখানেই ইতি! শোনা যায়, পরে কমল হাসানের বিয়ের খবরে এতটাই ভেঙে পড়েন নায়িকা যে তিনি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন!
এর পরে পরিচয় এবং প্রেম মলয়ালম ছবির পরিচালক জর্জ টমাসের সঙ্গে। এবারেও বিয়েতে বাধা দেয় পরিবার, কেন না জর্জ শ্রীবিদ্যাকে ধর্মান্তরিত হতে বলেছিলেন। এবার যদিও শ্রীবিদ্যা পরিবারের নিষেধ অগ্রাহ্য করে জর্জকে বিয়ে করেন। বিয়ে সুখের হয়নি। স্বামীর নজর ছিল নায়িকার সম্পদে, সব টাকা গ্রাস করে তিনি শ্রীবিদ্যাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন বলে শোনা যায়। ১৯৮০ সালে জর্জের সঙ্গে আইনত তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। কিন্তু, যা ক্ষতি হওয়ার, তত দিনে হয়েই গিয়েছে। আর্থিক নির্ভরশীলতা হারিয়ে বেশ অনেক দিন অসুবিধার মধ্যে কাটাতে হয় নায়িকাকে। আবার শুরু হয় জীবন সংগ্রাম, আবার টাকার জন্য লোকলজ্জা তুচ্ছ করে ফিরে আসতে হয় ক্যামেরার সামনে।
যদিও একেবারে ভেঙে পড়েননি শ্রীবিদ্যা। প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা তিনি করেন। হাই কোর্টে মামলা দায়ের করেন। শোনা যায়, দীর্ঘ কাল ধরে এই মামলা চলেছিল। যাই হোক, অবশেষে ভাগ্যলক্ষ্মী মুখ তুলে তাকান। মামলায় রায় আসে শ্রীবিদ্যার পক্ষে- নিজের সব সম্পত্তি তিনি যথাযথ ভাবে ফেরত পান। এর পরে মন দেন শুধুই অভিনয়ে। তামিল, তেলুগু এবং মলয়ালম ছবিতে অভিনয় করে চলেন সমানে। বলা হয়, ৪০ বছরের কেরিয়ারে তিনি ৪০০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। যদিও, অভিনয় জীবনের এই দ্বিতীয়ার্ধে সাফল্য সেভাবে আসেনি। শোনা যায়, এক সময়ে এতটাই খ্যাতির তুঙ্গে ছিলেন এই নায়িকা যে তাঁর দাবি বিনা শর্তে মেনে নিত দক্ষিণী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি।
এই নিয়ে লোকমুখে একটা গল্পও ফেরে। বলা হয় যে, একদা শ্রীবিদ্যার স্নানের জন্য এক ছবির প্রযোজক দুই বালতি বিসলেরি ওয়াটার আনিয়ে দিয়েছিলেন। এতটাই মূল্যবান তিনি ছিলেন একদা ছবির জগতে, সেই সময়ের প্রায় সব বিখ্যাত নায়কেরাই তাঁর সঙ্গে অভিনয় করার জন্য উন্মুখ ছিলেন। কেন না, শ্রীবিদ্যা মানেই তখন শুধু হিট ছবি। এই জনপ্রিয়তা অভিনয় জীবনের দ্বিতীয়ার্ধে আর ফিরে পাননি নায়িকা। ২০০৩ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শ্রীবিদ্যা। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর যাবতীয় সম্পদ দরিদ্র শিল্পীদের কল্যাণার্থে দান করে যান। দক্ষিণী ছবির নায়ক গণেশের হস্তক্ষেপে এই নিয়ে এক ট্রাস্টও তৈরি হয়। শ্রীবিদ্যাকে আজ আর অনেকেরই মনে নেই। কিন্তু দক্ষিণী ছবির ইতিহাসে, দরিদ্র শিল্পীদের জীবনে তিনি এখনও অমর!
Post navigation
Just another WordPress site