নয়াদিল্লি: বাংলাদেশের সরকারের পালা বদলের একমাস হয়ে গেল। গোটা দেশ জুড়ে অনিশ্চয়তা কাজ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলির একে অপরকে কাদা ছোড়াছুড়ি তো লেগেই আছে সাথে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দুই বিপক্ষ পার্টির সংঘাত– বর্তমানে দেশের মানুষের কাছে অন্যতম আলোচনার বিষয়। দেশ জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের পক্ষে একেবারেই শুভ নয়। দেশকে রাজনৈতিক দিক থেকে সংস্কার করার জন্য, ইতিমধ্যেই “স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট ডিসক্রিমিনেশন”, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে বলেছে। বাংলাদেশের এই প্রেক্ষাপটকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসাবেও দেখছে এই ছাত্র সংগঠন।
মহম্মদ ইউনূসের তত্বাবধানে 8 অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকারের পরামর্শ পরিষদ রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সংস্কার এবং মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে কাজ করছে। অরাজনৈতিক নব গঠিত সরকার, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে বিশিষ্ট মানুষেরা পরিচালনা করছেন। এই পরিষদ দলে আইন বিশেষজ্ঞ যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, চিকিৎসক থেকে শুরু করে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও।
“স্টুডেন্টস অ্যাগেনইস্ট ডিসক্রিমিনেশন”, ছাত্রদের এই মঞ্চের অনুরোধেই মহম্মদ ইউনূসের তত্বাবধানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। তাই এই দলের দুই সদস্যকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে রাখা হয়েছে। আওয়ামি লিগ সরকার পতনের পর, শেখ হাসিনার দলের গুরুত্ব বাংলাদেশে ভীষণ রকমের কমে গিয়েছে। আওয়ামি লিগের কোনও প্রতিনিধি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে নেই। এই বিষয়টি রাজনৈতিক ভাবেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ থেকে ইছামতী নদীতে ভাসল না প্রতিমা! বিসর্জন দেখতে গিয়ে টাকিতে হতাশ পর্যটকেরা!
হাসিনার গদিচ্যুত হওয়ার পরপরই বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ভাঙতে শুরু করে। আইনশৃঙ্খলারও অবনতি ঘটে। দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা পাওয়ার এই উদযাপনে, দেশটির আর্থরাজনৈতিক কাঠামোই নষ্ট হতে বসে। একাধিক হিংসাত্মক ঘটতে থাকে। প্রধানত বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু এবং আওয়ামি লিগের কর্মী-সমর্থকদের উপর বিরোধী শিবির থেকে আঘাত বর্ষাতে থাকে। শেখ হাসিনার গদিতে থাকাকালীন যেইসব জাতীয় স্মৃতি ছিল সবকিছুকে বিরোধী পক্ষ থেকে অবমাননার শিকার হতে হয়। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লিগের উপর ক্ষোভে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি এবং জামায়েত ইসলামি বাংলাদেশি এই ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। হাসিনা দায়িত্বে থাকাকালীন এই দুই পার্টিরই কার্যত ক্ষমতা বলতে কিছুই ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক পালাবদলে এই দুই দলেরই আসল হিংসাত্মক রূপ বেরিয়ে আসে।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরপরই বেশ কিছু ফতোয়া জারি হয়েছে। যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক চেতনার পরিপন্থী নয়। এই সরকার আসার পরেই, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার গৃহবন্দি দশা থেকে মুক্তি। তাঁর উপর যে মামলাগুলি চলছিল সেগুলির থেকেও তাকে নিষ্কৃতি দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড ১৫ অগাস্টে হয়, সেই দিনও সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সবথেকে চিন্তার বিষয়, চরমপন্থী দল জামায়াতের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। যা খুবই চিন্তার বিষয়।
অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কার এবং পররাষ্ট্র নীতির উপর বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার মন দিচ্ছে। ইউনূস প্রদর্শিত সরকার বর্তমানে একাধিক চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলারও অবস্থা তথৈবচ। একের পর এক হিংসাত্মক আক্রমণ বিরোধীদের উপর হয়েই চলেছে।
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম অর্থাৎ ছাত্রদের গোষ্ঠী, যারা দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন এনেছে, তারাই এখন দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হতাশ! দেশের একের পর এক সংঘর্ষ, হামলা নিয়ে তারা এর মধ্যেই মুখর। স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট ডিসক্রিমিনেশন- ইতিমধ্যেই দেশের এই অবনতির জন্য নিন্দায় মুখর হয়ে উঠেছে।
গোটা বাংলাদেশ জুড়ে সহিংসতার মূল কারণ হিসাবে দেখা হচ্ছে বিএনপি এবং জামায়েত ইসলামির তাণ্ডবমুখর আচরণকে। যা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ফিরে পাওয়ার ইচ্ছাকেই প্রকট করে তুলেছে। ছাত্ররাও সোশ্যাল মিডিয়ায়, জামাত ও বিএনপির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। #nobnp #nojamaat ব্যবহার করে তারা ইতিমধ্যেই স্বৈরাচারী দুই দলেরই বিরোধিতা করছে।
ছাত্ররা পরিবর্তনের পর যেই বাংলাদেশ আশা করেছিল, তা না পেয়ে প্রচণ্ড আশাহত। রাষ্ট্রের সম্পূর্ণরূপে সংস্কারের জন্য ছাত্রদের এই মঞ্চ ইতিমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছে।
বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে। আর এই সময়েই, বিএনপি এবং জামায়েত ইসলামি দ্রুত নির্বাচন করানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ দেওয়া শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই সরকার বদলের মূল কান্ডারি ছাত্র বিক্ষোভকারীরা নিজেদের রাজনৈতিক দল বানানোর কথা চিন্তা করছে। এর থেকেই বোঝা যায়, দেশের মূল দুই রাজনৈতিক দলকেই অগ্রাহ্য করছে ছাত্রদের এই গোষ্ঠী। অনেক কষ্টে ছিনিয়ে আনা এই মুক্তি তারা আর অতীতের মতন নষ্ট করতে চায় না।
জামাত ইসলামি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি ভাবে সমর্থন করার জন্য সারা বিশ্বের কাছে কুখ্যাত হয়ে রয়েছে। এই পার্টি বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের আগে হিংসা ছড়ানোর জন্য দ্বিতীয়বারের জন্য নিষিদ্ধ হয়। ২০১৩ সালে ধর্ম নির্ভর এই দল চরমপন্থা অবলম্বন করায় বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আনে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিএনপি সরকার থাকার সময়, জামাতের জোট তাদের সাথে ছিল। যারফলে ভোটে তাদের আসন সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও, তাদের রাজনৈতিক আকাঙ্খা সে অর্থে পূরণ হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেই জামাতের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জামাত ইসলামি, শরিয়া আইনের আওতায় বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ ইসলামি রাষ্ট্রতে রূপান্তরিত করার দাবি তুলেছে।
মহম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরেই জামাত ইসলামি বাংলাদেশের সংবিধান এবং জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করার জন্য দাবি জানিয়েছে। তবে নিজেরা যাতে রাজনৈতিক ভাবে মানুষের সামনে খাটো না হয়, তার জন্য এই দল সর্বসমক্ষে ধর্মীয় সম্প্রতির বার্তা দিলেও, মানুষের এই দলের প্রকৃত অভিসন্ধি বুঝতে অসুবিধা অসুবিধা হচ্ছে না। চরমপন্থী বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনগুলির সঙ্গে তাদের বৈঠক এবং বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্রে পরিবর্তিত করার পূর্ণ সমর্থন জামাত ইসলামি আবারও মাথা চাড়া দেওয়ার প্রমাণ। অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই আনসারুল্লাহ বাংলা দলের প্রধানকে মুক্তি দিয়েছে সঙ্গে জামাতের হিজবুত তাহেরি সংগঠনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়ার দাবিও প্রকাশ করছে যে বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলির রাষ্ট্রের উপর একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রকাশের ইচ্ছা কতটা সুদূরপ্রসারী।
বিএনপি এবং জামাত, এই দুই দলই বাংলাদেশে দ্রুত ভোটের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ দিচ্ছে। তবে এ কথাও দিনের আলোর মতন পরিষ্কার, বিএনপি-জামাতের জোট আবার নতুন করে তৈরি হওয়ার কোনও আশা নেই।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন আসার পরেই, বিএনপি এবং জামাত ইসলামী নিজেদের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এখন এটাই দেখার অন্তর্বর্তী সরকার নিজের লক্ষ্য ছুঁতে আদতে পারবে কীনা। বাংলাদেশ এখন গভীর সামাজিক-অর্থনৈতিক অসুবিধার সম্মুখীন, যা স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসাটাই প্রথম কাজ। সঠিক ভাবে দেশকে গড়ে তোলার পরেই আশা করা হচ্ছে বাংলাদেশ আবার নির্বাচন হবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেশে গঠিত না হলে ভোট করিয়ে কোনও কাজ হবে না বলে মতামত বিশেষজ্ঞদের। দ্রুত ভোট যেমন রাজনৈতিক দলগুলিকে আরও হিংসাত্মক কার্যকলাপে মদত জোগাবে তেমনই দেশের পরিস্থিতিকে আরও বেশি ভাবে স্বৈরাচারী শাসনের দিকে ঠেলে দেবে।