শুধু সত্যজিৎপুত্রকেই নয়, ফেলুদা নিয়ে কি কখনও পাঠকদের অভিমানী অনুযোগ শুনতে হয়েছিল স্বয়ং স্রষ্টাকেও? তাই কি ১৯৯১-এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত উপন্যাস ‘নয়ন রহস্য’ শুরুই হয়েছে মনমরা ফেলুদাকে দিয়ে? ধুরন্ধর কোনও প্রতিপক্ষ বা কিনারা না হওয়া চন্দননগরের মামলা নয়, বরং প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের বিমর্ষ হওয়ার কারণ ছিল পাঠকদের ছাপ্পান্ন চিঠি৷ যেখানে অনুযোগ ছিল ফেলুদার কাহিনী আর আগের মতো জমছে না৷ জটায়ুও আর সেরকম হাসাতে পারছে না৷ গল্পে ফেলুর বয়ানে পাঠকদের উত্তর দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়৷
কেন থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের অভিযান আগের মতো জমছে না, তার ব্যাখ্যা লেখক কী দিয়েছিলেন, সেটা নয়ন রহস্য পড়লেই জানা যাবে৷ তবে যেটা শিক্ষণীয়, সেটা হল সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন পাঠকদের মতামত উপেক্ষা তো দূর অস্ত্, বরং গুরুত্ব দিতেই হবে৷ কারণ তাঁরাই এতদিন ফেলুর পাশে ছিলেন৷ আজ টেলিভিশন-ইউটিউব-মাল্টিপ্লেক্স-ওটিটি সব ফরম্যাট মিলিয়ে সেই পাঠকরাই মূলত ফেলুদার দর্শক৷ সেই পাঠক-দর্শকরা সহমত যে ‘নয়ন রহস্য’ ফেলু মিত্তিরের স্বর্ণযুগের অভিযান নয়৷ জীবনের পড়ন্ত বেলায় লেখা এই উপন্যাসে সত্যজিৎ রায়ই এনেছেন ‘অকালবার্ধক্য’ বিশেষণ৷
সেই অভিযান এখন বড় পর্দায় আনলে হয় যুগের হাওয়ার সঙ্গে যুতসই করতে হবে, নয়তো দর্শককে পিছিয়ে নিয়ে যেতে হবে সিকি দশক আগে৷ এর মধ্যে প্রথমটা করতে যে মুনসিয়ানা দরকার, তার সুখস্মৃতি বাঙালিকে এখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে ‘সোনার কেল্লা’ এবং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ দেখার পর থেকে৷ আইকনিক এই দুই ছবির সঙ্গে তুলনা করা ছেড়েই দিয়েছেন দর্শক৷ এখন সাম্প্রতিকতম ফেলুদার ছবির তুলনা হয় তার আগেরটার সঙ্গে৷ সেদিক থেকে পরিচালক সন্দীপ রায়ের ‘নয়ন রহস্য’ ভাল হয়েছে ‘হত্যাপুরী’-র তুলনায়৷
উত্তরণের অন্যতম কারণ নয়ন বা জ্যোতিষ্কের ভূমিকায় শিশুশিল্পী অভিনব বড়ুয়ার নিষ্পাপ, গভীর অভিনয়৷ ‘হত্যাপুরী’ ছবিতে ছোট্ট ভূমিকায় অভিনয় করা এই খুদে ‘নয়ন রহস্য’-এ মনে করিয়ে দেয় ‘সোনার কেল্লা’-র কুশল চক্রবর্তী বা ‘তারে জমিন পর’-এর দর্শিল সাফারিকে৷ এই দুই ছবির মতো সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের এক বালকের চলার পথে বিপত্তিই ছবির ভরকেন্দ্র৷ কালীঘাটের নিকুঞ্জবিহারী লেনের ছাপোষা নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলে নয়ন সরকারের চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় ০ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা৷ সংখ্যাই হবে উত্তর, এমন কোনও প্রশ্ন তাকে করলেই পাওয়া যায় অব্যর্থ উত্তর৷ কারণ তখন সেই উত্তরের নির্দিষ্ট সংখ্যাগুলি পাশাপাশি বসে যায় তার চোখের সামনে৷ বাকি সংখ্যারা ভ্যানিশ হয়ে যায়৷ বাকিরা কেউ কিছুই টের পায় না৷
চোখ বন্ধ করে উত্তর দেওয়ার দৃশ্যগুলিতে অনুভবের অভিব্যক্তি অনবদ্য৷ সে সময় তাকে ঘিরে বিভিন্ন সংখ্যার নাচানাচি তুলে ধরাই যেত গ্রাফিক্সে৷ কিন্তু সে সব কিছু করাই হয়নি৷ ছবিতে স্মার্টফোন আছে, সোশ্যাল মিডিয়া নেই৷ কোনও শিশুর এরকম বিস্ময়ক্ষমতা আজকের দিনে থাকলে চোখের নিমেষে ভাইরাল হবে সে৷ সেই প্রসঙ্গ দেখানোই হল না৷ ম্যাজিশিয়ান সুনীল তরফদারের একটা শো থেকেই নয়ন চলে এল শিরোনামে৷ এবং একাধিক দুষ্টু লোকের নজরে৷
আরও পড়ুন : জীবনের সিলেবাসে যাঁরা কেমিস্ট্রিতে কাঁচা, তাঁদের কেমিস্ট্রিতেই বাঁচা
নয়নকে নিয়ে মাদ্রাজে (আজকের চেন্নাই) ম্যাজিক শো করতে যাওয়া, তার পর নয়নের অপহরণ, ফেলুদা কী করে তাকে উদ্ধার করবে, সেই পর্ব ফেলুভক্তদের বহুপঠিত৷ সেই বই-ই যদি পাতার পর পাতা চিত্রায়িত হয়, তাহলে তা দর্শকদের মনঃপীড়ার কারণ হয় বৈ কী! ‘হত্যাপুরী’-র তুলনায় ফেলুদার ভূমিকায় ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তর আড়ষ্টতা কমেছে ঠিকই৷ কিন্তু সংলাপ জড়তায় জড়ানো৷ যতই প্যান ইন্ডিয়া মুক্তি হোক না কেন, দর্শকদের মনে হবেই যে বাংলা বলায় অভিনেতার দুর্বলতা আড়াল করতেই হয়তো চিত্রনাট্যে হিন্দি ও ইংরেজির দাপট৷ সময়ে সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদা পাল্টাবে তো বটেই৷ কিন্তু তার চোখে যদি মগজাস্ত্রের ঝিলিক না থাকে, কথায় যদি রসবোধ না উঁকি দেয়, তাহলে তাঁকে নিয়ে দর্শক হাইলি সাসপিশাস হবেই৷
ফেলু মিত্তির ইন্দ্রনীলের মতোই তোপসের ভূমিকায় আয়ুষ দাস এবং জটায়ুর চরিত্রে অভিজিৎ গুহ আগের তুলনায় কিছুটা ছন্দোবদ্ধ হয়েছেন ঠিকই৷ কিন্তু প্রশ্ন হল পাঞ্জাবীতে কলম গোঁজা থাকলেই কি লালমোহন গাঙ্গুলি হওয়া যায়? ছবিতে জটায়ুর পাঞ্জাবী, জামায় সব সময় কলম গোঁজা৷ কিন্তু নোটবুকে কাউকে কাল্টিভেট করার জন্য একবারও তিনি সেটা ব্যবহার করেন না৷ ছবির বাকি কুশীলবদের মধ্যে মোহন আগাশে, দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, ভরত কৌল যথাযথ৷ অতিনাটকীয় লেগেছে সুপ্রিয় দত্তকে৷ ছবিতে চরিত্র অনুযায়ী তাঁর মেকআপও আরও ভাল হতে পারত৷ আরও বেশি থাকতে পারত নস্টালজিয়ায় ডুব দেওয়া থিম মিউজিক৷ গাওয়াঙ্গিকে করা যেত চরম ভীতিজনক৷ যবনিকা পতন অবিকল বইয়ের লাইনের মতো না হলেও ক্ষতি ছিল না৷
ছোটদের মধ্যে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার বিচ্ছুরণ বার বার উঠে এসেছে সত্যজিতের কলমে৷ ‘সোনার কেল্লা’, ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও খোকা’, ‘নয়ন রহস্য’- সব গল্পেই বিস্ময়কর সেই ক্ষমতা হারিয়ে গিয়ে ফিরে এসেছে সুস্থ স্বাভাবিক শৈশব৷ বিশেষ করে ‘সোনার কেল্লা’ এবং ‘নয়ন রহস্য’ তো পটভূমির দিক থেকে বেশ কাছাকাছি৷ দুটো গল্পেই দুষ্টু লোক এবং সম্মোহন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷ অনাবিল সেই ম্যাজিকে সম্মোহিত হয়ে থাকতেই ভালবাসেন ফেলুঅনুরাগীরা৷ অতিরিক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা, কাঁটাছেঁড়া ছাড়া রায়বাড়ির ছাপাখানার, সন্দেশের সাদাকালো পাতার, পুজোবার্ষিকীর গন্ধমাখা নিটোল প্রদোষচন্দ্র মিত্র বার বার ফিরে আসুন তপেশরঞ্জন এবং লালমোহনবাবুর সঙ্গে ব্রোমান্স নিয়ে৷ তবে আর্ডিনারি নয়, ‘এক্সট্রা আর্ডিনারি’ ছবি হয়েই৷