All posts by Arpita Roy Chowdhury

Senior Sub Editor-News18Bangla Digital, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরের পর সাংবাদিকতার সঙ্গে গাঁটছড়া প্রায় দু’ দশকের৷ সঞ্চয়ের ঝুলিতে জড়ো হয়েছে প্রিন্ট, অডিও ভিস্যুয়াল এবং ডিজিটাল মাধ্যমে কাজের অভিজ্ঞতা৷ ফিচারমূলক লেখার মাঝে খুঁজে পান প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি৷ তবে পড়ার ক্ষেত্রে সর্বভুক৷ অবসরে নিষ্ঠাবান এই বইপোকার অন্তরঙ্গ প্রেম ভ্রমণের সঙ্গেও৷ Email ID- arpita.chowdhury@nw18.com

Nayan Rahasya Movie Review: দেখো রে নয়ন মেলে অভিনবের অভিনয়! কিন্তু কতটা জমল ফেলু মিত্তিরের মগজাস্ত্রের অভিযান?

শুধু সত্যজিৎপুত্রকেই নয়, ফেলুদা নিয়ে কি কখনও পাঠকদের অভিমানী অনুযোগ শুনতে হয়েছিল স্বয়ং স্রষ্টাকেও? তাই কি ১৯৯১-এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত উপন্যাস ‘নয়ন রহস্য’ শুরুই হয়েছে মনমরা ফেলুদাকে দিয়ে? ধুরন্ধর কোনও প্রতিপক্ষ বা কিনারা না হওয়া চন্দননগরের মামলা নয়, বরং প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের বিমর্ষ হওয়ার কারণ ছিল পাঠকদের ছাপ্পান্ন চিঠি৷ যেখানে অনুযোগ ছিল ফেলুদার কাহিনী আর আগের মতো জমছে না৷ জটায়ুও আর সেরকম হাসাতে পারছে না৷ গল্পে ফেলুর বয়ানে পাঠকদের উত্তর দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়৷

কেন থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের অভিযান আগের মতো জমছে না, তার ব্যাখ্যা লেখক কী দিয়েছিলেন, সেটা নয়ন রহস্য পড়লেই জানা যাবে৷ তবে যেটা শিক্ষণীয়, সেটা হল সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন পাঠকদের মতামত উপেক্ষা তো দূর অস্ত্, বরং গুরুত্ব দিতেই হবে৷ কারণ তাঁরাই এতদিন ফেলুর পাশে ছিলেন৷ আজ টেলিভিশন-ইউটিউব-মাল্টিপ্লেক্স-ওটিটি সব ফরম্যাট মিলিয়ে সেই পাঠকরাই মূলত ফেলুদার দর্শক৷ সেই পাঠক-দর্শকরা সহমত যে ‘নয়ন রহস্য’ ফেলু মিত্তিরের স্বর্ণযুগের অভিযান নয়৷ জীবনের পড়ন্ত বেলায় লেখা এই উপন্যাসে সত্যজিৎ রায়ই এনেছেন ‘অকালবার্ধক্য’ বিশেষণ৷

সেই অভিযান এখন বড় পর্দায় আনলে হয় যুগের হাওয়ার সঙ্গে যুতসই করতে হবে, নয়তো দর্শককে পিছিয়ে নিয়ে যেতে হবে সিকি দশক আগে৷ এর মধ্যে প্রথমটা করতে যে মুনসিয়ানা দরকার, তার সুখস্মৃতি বাঙালিকে এখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে ‘সোনার কেল্লা’ এবং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ দেখার পর থেকে৷ আইকনিক এই দুই ছবির সঙ্গে তুলনা করা ছেড়েই দিয়েছেন দর্শক৷ এখন সাম্প্রতিকতম ফেলুদার ছবির তুলনা হয় তার আগেরটার সঙ্গে৷ সেদিক থেকে পরিচালক সন্দীপ রায়ের ‘নয়ন রহস্য’ ভাল হয়েছে ‘হত্যাপুরী’-র তুলনায়৷

উত্তরণের অন্যতম কারণ নয়ন বা জ্যোতিষ্কের ভূমিকায় শিশুশিল্পী অভিনব বড়ুয়ার নিষ্পাপ, গভীর অভিনয়৷ ‘হত্যাপুরী’ ছবিতে ছোট্ট ভূমিকায় অভিনয় করা এই খুদে ‘নয়ন রহস্য’-এ মনে করিয়ে দেয় ‘সোনার কেল্লা’-র কুশল চক্রবর্তী বা ‘তারে জমিন পর’-এর দর্শিল সাফারিকে৷ এই দুই ছবির মতো সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের এক বালকের চলার পথে বিপত্তিই ছবির ভরকেন্দ্র৷ কালীঘাটের নিকুঞ্জবিহারী লেনের ছাপোষা নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলে নয়ন সরকারের চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় ০ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা৷ সংখ্যাই হবে উত্তর, এমন কোনও প্রশ্ন তাকে করলেই পাওয়া যায় অব্যর্থ উত্তর৷ কারণ তখন সেই উত্তরের নির্দিষ্ট সংখ্যাগুলি পাশাপাশি বসে যায় তার চোখের সামনে৷ বাকি সংখ্যারা ভ্যানিশ হয়ে যায়৷ বাকিরা কেউ কিছুই টের পায় না৷

চোখ বন্ধ করে উত্তর দেওয়ার দৃশ্যগুলিতে অনুভবের অভিব্যক্তি অনবদ্য৷ সে সময় তাকে ঘিরে বিভিন্ন সংখ্যার নাচানাচি তুলে ধরাই যেত গ্রাফিক্সে৷ কিন্তু সে সব কিছু করাই হয়নি৷ ছবিতে স্মার্টফোন আছে, সোশ্যাল মিডিয়া নেই৷ কোনও শিশুর এরকম বিস্ময়ক্ষমতা আজকের দিনে থাকলে চোখের নিমেষে ভাইরাল হবে সে৷ সেই প্রসঙ্গ দেখানোই হল না৷ ম্যাজিশিয়ান সুনীল তরফদারের একটা শো থেকেই নয়ন চলে এল শিরোনামে৷ এবং একাধিক দুষ্টু লোকের নজরে৷

আরও পড়ুন : জীবনের সিলেবাসে যাঁরা কেমিস্ট্রিতে কাঁচা, তাঁদের কেমিস্ট্রিতেই বাঁচা

নয়নকে নিয়ে মাদ্রাজে (আজকের চেন্নাই) ম্যাজিক শো করতে যাওয়া, তার পর নয়নের অপহরণ, ফেলুদা কী করে তাকে উদ্ধার করবে, সেই পর্ব ফেলুভক্তদের বহুপঠিত৷ সেই বই-ই যদি পাতার পর পাতা চিত্রায়িত হয়, তাহলে তা দর্শকদের মনঃপীড়ার কারণ হয় বৈ কী! ‘হত্যাপুরী’-র তুলনায় ফেলুদার ভূমিকায় ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তর আড়ষ্টতা কমেছে ঠিকই৷ কিন্তু সংলাপ জড়তায় জড়ানো৷ যতই প্যান ইন্ডিয়া মুক্তি হোক না কেন, দর্শকদের মনে হবেই যে বাংলা বলায় অভিনেতার দুর্বলতা আড়াল করতেই হয়তো চিত্রনাট্যে হিন্দি ও ইংরেজির দাপট৷ সময়ে সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদা পাল্টাবে তো বটেই৷ কিন্তু তার চোখে যদি মগজাস্ত্রের ঝিলিক না থাকে, কথায় যদি রসবোধ না উঁকি দেয়, তাহলে তাঁকে নিয়ে দর্শক হাইলি সাসপিশাস হবেই৷

ফেলু মিত্তির ইন্দ্রনীলের মতোই তোপসের ভূমিকায় আয়ুষ দাস এবং জটায়ুর চরিত্রে অভিজিৎ গুহ আগের তুলনায় কিছুটা ছন্দোবদ্ধ হয়েছেন ঠিকই৷ কিন্তু প্রশ্ন হল পাঞ্জাবীতে কলম গোঁজা থাকলেই কি লালমোহন গাঙ্গুলি হওয়া যায়? ছবিতে জটায়ুর পাঞ্জাবী, জামায় সব সময় কলম গোঁজা৷ কিন্তু নোটবুকে কাউকে কাল্টিভেট করার জন্য একবারও তিনি সেটা ব্যবহার করেন না৷ ছবির বাকি কুশীলবদের মধ্যে মোহন আগাশে, দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, ভরত কৌল যথাযথ৷ অতিনাটকীয় লেগেছে সুপ্রিয় দত্তকে৷ ছবিতে চরিত্র অনুযায়ী তাঁর মেকআপও আরও ভাল হতে পারত৷ আরও বেশি থাকতে পারত নস্টালজিয়ায় ডুব দেওয়া থিম মিউজিক৷ গাওয়াঙ্গিকে করা যেত চরম ভীতিজনক৷ যবনিকা পতন অবিকল বইয়ের লাইনের মতো না হলেও ক্ষতি ছিল না৷

ছোটদের মধ্যে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার বিচ্ছুরণ বার বার উঠে এসেছে সত্যজিতের কলমে৷ ‘সোনার কেল্লা’, ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও খোকা’, ‘নয়ন রহস্য’- সব গল্পেই বিস্ময়কর সেই ক্ষমতা হারিয়ে গিয়ে ফিরে এসেছে সুস্থ স্বাভাবিক শৈশব৷ বিশেষ করে ‘সোনার কেল্লা’ এবং ‘নয়ন রহস্য’ তো পটভূমির দিক থেকে বেশ কাছাকাছি৷ দুটো গল্পেই দুষ্টু লোক এবং সম্মোহন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷ অনাবিল সেই ম্যাজিকে সম্মোহিত হয়ে থাকতেই ভালবাসেন ফেলুঅনুরাগীরা৷ অতিরিক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা, কাঁটাছেঁড়া ছাড়া রায়বাড়ির ছাপাখানার, সন্দেশের সাদাকালো পাতার, পুজোবার্ষিকীর গন্ধমাখা নিটোল প্রদোষচন্দ্র মিত্র বার বার ফিরে আসুন তপেশরঞ্জন এবং লালমোহনবাবুর সঙ্গে ব্রোমান্স নিয়ে৷ তবে আর্ডিনারি নয়, ‘এক্সট্রা আর্ডিনারি’ ছবি হয়েই৷

Satyajit Ray Birth Anniversary :‘ফেলুদাকে চিনি না, আমি ব্যোমকেশ পড়ি, স্বপনকুমার আমার খুব ভাল লাগে!’ ৫০ বছর আগে সত্যজিৎকে বলেছিলেন হবু তোপসে

কলকাতা : ‘‘স্মার্ট ছেলেরা এসব পাউডার টাউডার মাখে নাকি!’’ এই এককথায় তোপসের ইচ্ছেয় জল ঢেলেছিলেন দীর্ঘদেহী স্রষ্টা৷ ফলে এক বিন্দু মেকআপ না করেই তপেশরঞ্জন মিত্র হয়ে জীবনে প্রথম বার পর্দায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন পাঠভবন স্কুলের প্রাক্তনী৷ ‘সোনার কেল্লা’ ছবি ঘিরে এরকমই শতেক স্মৃতিচারণায় ১ মে ভরে উঠেছিল নন্দন প্রেক্ষাগৃহ৷ একটু আগেই বাইরে তখন বৈশাখের তপ্ত দুপুর৷ আর্দ্রতা, ঘাম, তাপপ্রবাহ সবকিছুকে ছাপিয়ে অপেক্ষা করে আছে সর্পিল লাইন৷ সেই ভিড়ে নানাবয়সিদের মধ্যে চমকে দিচ্ছে আজকের প্রজন্মের উপস্থিতিও৷ সকলে অপেক্ষা করে ছিলেন ‘সোনার কেল্লা’-র সংরক্ষিত সংস্করণ বা রেস্টোর্ড ভার্সন প্রথম বার বড় পর্দায় দেখবেন বলে৷ ৫০ বছর আগে মুক্তি পাওয়া এই ছবি শুধু স্মৃতি নয়৷ বরং ফেলুভক্ত বাঙালির দিনযাপনের অঙ্গ৷ এই ছবির প্রতিটা মুহূর্ত, সংলাপ জড়িয়ে গিয়েছে বঙ্গজদের শ্বাস প্রশ্বাসে৷ সেই কথাই আরও একবার ধরা পড়ল পরিপূর্ণ নন্দনে৷

‘সোনার কেল্লা’ ছবির ৫০ বছর উপলক্ষে সত্যজিৎ রায়ের জন্মবার্ষিকীর আগের দুপুরে ‘সোসাইটি ফর দ্য প্রিজারভেশন অব সত্যজিৎ রায় আর্কাইভস’-এর উদ্যোগে নন্দনে আয়োজিত হয়েছিল আলোচনাসভার৷ যোগ দিয়েছিলেন অশোক মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়, শান্তনু বাগচী এবং কুশল চক্রবর্তী৷ সেখানে আইকনিক ছবির এই কয়েকটি মুখ নিজেরাও ফিরে গেলেন অর্ধশতক আগের জয়লসমীরে৷ সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন দর্শকদেরও৷ আলোচনার সূত্রধর তথা সঞ্চালক ছিলেন পরিচালক সন্দীপ রায়৷ সত্যজিৎপুত্র নিজেও ছিলেন এই ছবির ইউনিটের অন্যতম সদস্য৷ সঞ্চালক প্রথমেই মাইক্রোফোন দিলেন সেই ‘সাংবাদিক’-এর হাতে৷ ‘মুকুল ধর কি জাতিস্মর’ শিরোনামে যাঁর প্রতিবেদন দেখে গুপ্তধনের খোঁজে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন অমিয়নাথ বর্মন এবং মন্দার বোস৷

ছবির সেই আংটি পরা সাংবাদিক অশোক মুখোপাধ্যায় আজ প্রবীণ৷ জানালেন তাঁর মঞ্চাভিনয় দেখে ভাল লেগেছিল সত্যজিৎ রায়ের৷ সাতের দশকে তাঁর বাড়িতে টেলিফোন ছিল না৷ পড়শির বাড়িতে ফোন করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়৷ জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাঁর ছবিতে ছোট ভূমিকায় অভিনয় করতে অশোক রাজি কিনা৷ শুনে মঞ্চের দাপুটে অভিনেতা অশোক বলেছিলেন, রাজি হবেন না মানে! সত্যজিৎ রায়ের ছবির শ্যুটিঙে শুধু দাঁড়িয়ে থেকে দেখার অনুমতি পেলেও তিনি আগ্রহী৷

তিন দিনের বদলে দু’দিনেই হয়ে গিয়েছিল অশোকের কাজ৷ তাঁর সঙ্গে একই দৃশ্যে ছিলেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষ৷ ছবিতেও তিনি ছিলেন চিত্রগ্রাহকের ভূমিকাতেই৷ তবে তাঁর আক্ষেপ ছিল যে ছবিতে তিনি সংলাপহীন৷ পরিচালককে বলেছিলেন, ‘মানিকদা, আপনি সব সংলাপ তো অশোককেই দিয়ে দিলেন৷’ সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়েছিল নতুন সংলাপ৷ আলোকচিত্রী বলেছিলেন, ‘একটু হাসো তো খোকা৷ হাসো৷ হাসলে ছবি ভাল হয়৷’ উত্তরে মুকুল বলেছিল ‘আমার হাসি পাচ্ছে না৷’ কিংবদন্তির ইম্প্রোভাইজেশনও আজ মাইলফলক৷

ছবিতে আগাগোড়া গোমড়া মুকুলের মুখে হাসি ফুটেছিল শেষ দৃশ্যে৷ যখন গাড়িচালকের পাঁজাকোলাবন্দি হয়ে সোনার কেল্লা ছাড়ছেন নকল ডাক্তার হাজরা৷ ফেলুদা, তোপসেদার সঙ্গে কলকাতায় নিজের বাড়িতে ফিরেছিল মুকুল নিজেও৷ সেই যে পূর্বজন্মের ফেলে আসা ভাঙা বাড়ি ছেড়েছিল মুকুল, গিয়েছিল চার দশক পর, ২০১৬ সালে৷ মঞ্চে বসে অতীতে ফিরেছিলেন অভিনেতা কুশল চক্রবর্তী৷ বললেন দ্বিতীয় বার সোনার কেল্লায় গিয়ে অভূতপূর্ব অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন৷ দেখেছিলেন তাঁর নামে দোকান৷ যেখানে থরে থরে সাজানো আছে ‘সোনার পাথরবাটি’৷ জয়সলমীরের স্থানীয়রা তাঁকে বলেছিলেন, সত্যজিতের ছবির আগে রাজস্থানের বাকি অংশের লোকেরা ওই জেলাকে বলত ‘যাঃ শালে মর!’ অর্থাৎ এতটাই বন্ধুর, প্রতিকূল ছিল সীমান্তবর্তী ওই এলাকা, যে ওখানে গেলে মৃত্যু অবধারিত৷ সেই শহরকে পর্যটন মানচিত্রে প্রথমসারিতে বসিয়েছেন সত্যজিৎ৷ তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ জয়সলমীরবাসীরা কুশলকে বলেছিলেন, ‘‘মাথার উপরে ভগবান৷ পায়ের নীচে বালি৷ আর আমাদের পাশে সত্যজিৎ৷ উনি আমাদের ভাস্কোদাগামা৷ আমাদের আবিষ্কার করে উনিই পরিচিতি দিয়েছেন৷’’

নন্দনে ‘সোনার কেল্লা’-র কুশীলবরা

এহেন ফেলুস্রষ্টাকে কিনা মুখের উপর সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা কিশোর সিদ্ধার্থ বলেছিলেন ‘‘আমি ব্যোমকেশ পড়ি৷ খুব একটা বুঝি না৷ স্বপনকুমার খুব ভাল লাগে৷ তবে কে ফেলুদা, আমি চিনি না৷’’ স্কুলের শিক্ষক পার্থ বসুর বাড়িতে বাংলা ব্যাকরণ বুঝতে গিয়েছিলেন সাড়ে তেরো বছরের সিদ্ধার্থ৷ সেখান থেকে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে সোজা বিশপ লেফ্রয় রোডের আমোঘ বাড়িতে৷ তাঁর স্বপনকুমারপ্রীতি জেনে একটুও রেগে যাননি সত্যজিৎ৷ বরং একটু একটু করে নানা কথায় আগ্রহী করে তুলেছিলেন অভিনয়ে৷ যদিও ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়ে প্রথমেই নাকচ করেছিলেন স্কুলপড়ুয়া৷ জানতেন বাবা মা’র অনুমতি মিলবে না৷ কিন্তু সত্যজিতের ব্যক্তিত্বের কাছে শেষ পর্যন্ত নতজানু হয়েছিল অভিভাবকের আপত্তি৷ ফেলুবেশী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাওড়ার ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ৭ নম্বর আপ তুফান এক্সপ্রেসে তোপসে হয়ে বসেছিলেন সিদ্ধার্থ৷ ফেলুর মতো মাস্টার যেমন তোপসে পেল না৷ ঠিক তেমনই, অভিনয় থেকে বহুদূরে নিজের পেশায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ হলেও নামী রেস্তরাঁর কর্ণধার সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বঙ্গহৃদয়ে বিরাজ করে গেলেন প্রদোষচন্দ্র মিত্রের স্যাটেলাইট হয়েই৷

সন্দীপ রায় এবং সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়

পাঠভবনের প্রাক্তন শিক্ষক পার্থ বসুর সূত্রে দ্বিতীয় মুকুল শান্তনু বাগচীকেও খুঁজে পেয়েছিলেন সত্যজিৎ৷ তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপের দৃশ্য আজও ভাসে সন্দীপের চোখে৷ বললেন তাঁরা শান্তনুর বাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন৷ পর্দার পিছন থেকে স্কিড করে এসে ঘরে ঢুকেছিল সেই খুদে৷ এই আবির্ভাবেই মুগ্ধ হন সত্যজিৎ৷ পরে ছবিতেও পর্দার পিছন থেকেই উকিল ঠাকুরদা শিবরতন মুখুজ্যের বৈঠকখানায় বসে থাকা ফেলুদাদের সামনে আসে ‘বেলুচিস্তান থেকে আগত’দের হাতে অপহৃত হওয়া দ্বিতীয় মুকুল৷ এয়ারগান হাতে তার বলা ‘মিসটেক, মিসটেক’ আজ অমর সংলাপ৷ ঘটনাচক্রে তিনি নিজেও আজ পরিচালক৷ বললেন ছোটদের সঙ্গে সত্যজিৎ মিশতেন বন্ধুর মতো৷ তাই পর্দায় তাঁর শিশুচরিত্ররা এত প্রাণবন্ত, এত সাবলীল৷ তাঁকে একবাক্যে সমর্থন করলেন মঞ্চে বসা সিদ্ধার্থ এবং কুশলও৷

ঠিক একইভাবে বন্ধু হয়ে ছ’ বছরের কুশলকে সত্যজিৎ বলেছিলেন পছন্দের থিয়েটার থেকে কিছু অভিনয় করে দেখাতে৷ ছোট্ট কুশল নাটক দেখতে ভালবাসতেন৷ বাড়িতে দিব্যি নকলও করতেন তাবড় অভিনেতাদের৷ ঠিক সেভাবেই অতশত কিছু না ভেবে সত্যজিতের বৈঠকখানায় তিনি অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন ‘তিন পয়সার পালা’ থেকে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে৷ সঙ্গে তাঁর হাতের আঁকাও মুগ্ধ করেছিল পরিচালককে৷ ছবিতেও নানা দৃশ্যে মুকুলকে ছবি আঁকতে দেখা গিয়েছে৷ পূর্বজন্মের টুকরো স্মৃতির ঘোরে ভেসে আসা রতনদের বাড়ি, গিরিধারীর বাড়ি, তাদের হোলি খেলার জায়গা সে ধরে রাখত আঁকার খাতাতেই৷

 

নন্দনে সোনার কেল্লা-র সংরক্ষিত সংস্করণ প্রদর্শনের আগে তিন চার মিনিটের কিছু ফুটেজ দেখানো হয় স্ক্রিনে৷ শ্যুটিঙের সময় সেই মুহূর্তগুলি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন সন্দীপ রায়৷ অমূল্য সেই ছবিতে শ্যুটিঙে মগ্ন সত্যজিৎ৷ পরম যত্নে তৈরি করছেন, আগলে রাখছেন আমাদের ছোটবেলা৷ যাতে আমরাও মুকুলের মতো কোনওদিন বড় না হই৷ বড় না হওয়া সেই দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালিতে ভেসে গেল পর্দায় ৫০ বছর আগে ২৭ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়া এক ম্যাজিক৷

Chemistry Mashi Review: জীবনের সিলেবাসে যাঁরা কেমিস্ট্রিতে কাঁচা, তাঁদের কেমিস্ট্রিতেই বাঁচা

‘কেমিস্ট্রি’ এবং ‘মাসি’ এই দুই শব্দ যে পাশাপাশি বসতে পারে, সেটাই এতদিন গতানুগতিক চিন্তাভাবনার বাইরে ছিল৷ সেই ভাবনাকেই ছকভাঙা চিন্তায় দ্রবীভূত করেছে হইচই-এর সিরিজ ‘কেমিস্ট্রি মাসি’৷ জায়মান হয়ে মিলিয়ে গিয়েছে পুরনো চিন্তাভাবনা ও হিসেবনিকেশ। সৌরভ চক্রবর্তী পরিচালিত এই সিরিজেই ওটিটি-তে আত্মপ্রকাশ হয়েছে দেবশ্রী রায়ের৷ বিনোদনের এই নতুন মাধ্যমে আবির্ভাবেই বাজিমাত করেছেন তিনি৷ অভিনয় দক্ষতার রসায়নে বুঝিয়েছেন মাধ্যম যা-ই হোক না কেন৷ কুশীলবের দক্ষতাই শেষ কথা৷

দেবশ্রী রায় অভিনীত শেষ ধারাবাহিক ‘সর্বজয়া’-র চরিত্রের কিছুটা হলেও ছায়া পড়েছে কেমিস্ট্রি মাসি সুচরিতা লাহিড়ির উপর৷ কাহিনিতে সুচরিতা জৈব রসায়নে স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম৷ কিন্তু তাঁর ‘ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট’ পরিচয় চলে গিয়েছে বৈঠককানার মানানসই কুশনকভারে আড়ালে আর রান্নাঘরে ফোড়নের ছ্যাঁকছোঁকে৷ ওজনদার সরকারি চাকুরে স্বামী সুশোভন চান তাঁর স্ত্রীর পরিচয়েই খুশি থাকুন সুচরিতা৷ ছেলে ঋভুরও ইচ্ছে, জীবনে বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষার পথে যেন মা না হাঁটেন৷ তবুও সুচরিতার পড়ানোর ইচ্ছে, শিক্ষকতার স্বপ্ন পল্লবিত হতে থাকে গৃহকোণের পাতাবাহারের মতোই৷

ইচ্ছে আর ভালবাসাকে লালন করতেই যেন সুচরিতা পড়ান৷ তাঁর গৃহ সহায়িকার ছেলের কেমিস্ট্রি দিদিমণি হয়ে ওঠেন৷ তাঁর সেই ছোট্ট পা ফেলাই একদিন হয়ে দৃপ্ত পদচারণা৷ অনলাইন শিক্ষকতার মধ্যমণি হয়ে ওঠেন সুচরিতা৷ ঘরে ঘরে পড়ুয়াদের অগাধ ভরসা কেমিস্ট্রি মাসির উপর৷ যাত্রার এই উড়ানে সুচরিতা বাড়িতে সাহায্য পান কেবল তাঁর পুত্রবধূর৷ পরের প্রজন্মের এই তরুণীর সাহচর্যেই সুচরিতা ক্যামেরার মুখোমুখি হয়ে কাটিয়ে ওঠেন আড়ষ্টতা৷ বুঝতে পারেন রান্নাঘরই সবথেকে বড় রসায়নের পরীক্ষাগার৷ তাই রান্না করতে করতে, রান্নার উপকরণের যুগলবন্দিতেই প্রাঞ্জল করে তোলেন কেমিস্ট্রির গূঢ় তত্ত্ব৷ বুঝিয়ে দেন সমীকরণের জটিলতা৷

আরও পড়ুন : দুই হাতে দু’টো বন্দুক, আর এক হাতে একটা টর্চ নিয়ে রেকর্ড ভাঙা চুম্বনে হৃদয়হরণ দীপক চ্যাটার্জির, থুড়ি আবীরের!

সহজ, সাবলীল কথা বলা, পাঠ্য বোঝানোই কেমিস্ট্রি মাসির তুরুপের তাস৷ কিন্তু সুচরিতার জনপ্রিয়তা বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে তাঁর অন্দরমহলের সহজপাঠ ৷ অনলাইন কোচিং-য়ের ক্লাস নেওয়ার ভিডিও রেকর্ড করতে শেষে বাড়ি ছাড়েন তিনি৷ বাড়ি ছাড়লেও সংসার ছাড়েননি৷ অন্যত্র একাকী থাকতে শুরু করলেও তাঁর সুচারু, সুপটু নির্দেশেই চলত ঘরকন্না৷ দৃঢ়চেতা স্ত্রীর একরোখা মনোভাবে সায় না থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে অসম্মান করেননি উচ্চপদস্থ স্বামী৷

কেমিস্ট্রি মাসি সুচরিতার চরিত্রে কোথায় যেন উঁকি দিয়ে যান বাস্তবে অনলাইন শিক্ষকতার দুনিয়ায় তুমুল জনপ্রিয় ‘খান স্যর’৷ তিনিও জনপ্রিয় তাঁর বাচনভঙ্গি ও পঠনপাঠনের প্রাঞ্জল ধরনের দৌলতে৷ তাঁদের সহজিয়া
দর্শনেই খোঁজা হয়েছে জটিল ব্যাধির উত্তর৷ উচ্চশিক্ষার পথে আর্থিক অস্বচ্ছলতার বাধাকে ধূলিসাৎ করতে ইন্টারনেট নিজেদের চ্যানেলই হাতিয়ার এই শিক্ষক শিক্ষিকাদের৷

সহজ পথে পাওয়া সাফল্যই কেমিস্ট্রি মাসি সুচরিতাকে দাঁড় করিয়ে দিল নামী বেসরকারি শিক্ষণ-সংস্থার অসূয়ার চাঁদমারিতে৷ কারণ কেমিস্ট্রি মাসির জোয়ারের আকর্ষণে ভাটার টান তাদের পড়ুয়া সংখ্যায়৷ একজন গৃহবধূ তাঁদের মূল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবেন, সেটা মানতে অপারগ বড় ব্র্যান্ড৷ ফলত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জেল খাটতে হয় সুচরিতাকে৷ সমস্যায় পড়তে হয় এন্ট্রান্স বোর্ডে সুচাকুরে তাঁর স্বামীকে৷ এই সিরিজে উঠে এসেছে শিক্ষাব্যবস্থাকে জড়িয়ে একাধিক প্রাসঙ্গিক, সামাজিক ও জ্বলন্ত সমস্যা৷

অভিনয়ে দেবশ্রী রায়কে যোগ্য সঙ্গত করেছেন তাঁর স্বামীর ভূমিকায় শঙ্কর চক্রবর্তী৷ দু’জনের বলিষ্ঠ উপস্থিতিতে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে মধ্যবয়সি দম্পতির সম্পর্কের টানাপড়েন৷ অন্যান্য ভূমিকায় প্রশংসার দাবি রাখে শঙ্কর চক্রবর্তী, সপ্তর্ষি মৌলিক, শ্রেয়া ভট্টাচার্য, সৌম্য মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়৷ ভাবনাচিন্তার ছাপ আছে চরিত্রদের পোশাক পরিকল্পনাতেও৷ ইমন চক্রবর্তীর কণ্ঠে সিরিজের শীর্ষ সঙ্গীতও শ্রুতিমধুর৷ তবে সংলাপে আরও শান, প্রাণ এবং গতি প্রয়োজন৷

তাহলে কেমিস্ট্রি মাসির স্বপ্নের উড়ান কি থমকে গেল? নাকি ভুলে ভরা সিস্টেমের বিরুদ্ধে জারি থাকবে সুচরিতার লড়াই? উত্তর নিয়ে আসবে সিরিজের দ্বিতীয় মরশুম৷ তত দিন পর্যন্ত জীবনের সিলেবাসে যাঁরা কেমিস্ট্রিতে কাঁচা, তাঁদের কেমিস্ট্রিতেই বাঁচা জারি থাকুক৷