শীর্ষা গুহঠাকুরতা

Shirsha Guha Thakurta Exclusive Interview: ঘরজুড়ে সত্যজিতের ছবি, আমার জন্য মাছের ঝোল আনা… বিদ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বাঙালি: শীর্ষা

কলকাতা: যাত্রাপথটা কলকাতা থেকে মুম্বই না হলেও শিকড় তো সেই এই শহরেই। অনেক ছোট বয়সেই কলকাতা ছেড়ে মুম্বই পাড়ি। যদিও বাবা-মা আজও কলকাতারই বাসিন্দা। কিন্তু তাঁদের মেয়েকে এখন মুম্বইয়ের বাঙালিই বলা চলে। আর আজ তাঁর জন্য গর্বিত বাংলা। নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করেছেন তিনি নিজেই। বিজ্ঞাপনী ছবির জগতে নিজের নাম তৈরি করেছেন অনেকদিন আগেই। আর আজ তিনি বলিউডের সুপারস্টার বিদ্যা বালনকে নিয়ে নিজের প্রথম ফিচার ছবি বানিয়ে ফেলেছেন। তিনি শীর্ষা গুহঠাকুরতা। নিউজ18 বাংলায় তিস্তা রায় বর্মণের সঙ্গে অকপট আড্ডায় মুম্বইয়ের বাঙালি পরিচালক।

প্রশ্ন: কলকাতার মেয়ে হলেও ক্লাস টেনের পর থেকেই তো শহরছাড়া। এক কথায় আপনি মুম্বইয়ের বাঙালি। তাও কি এখনও বাংলায় দখল রয়েছে?

শীর্ষা: অবশ্যই। আমি এখনও বাংলাতেই ভাবি। আমার মা-বাবা কলকাতাতে থাকে বলে মাসে একবার করে মুম্বই থেকে কলকাতা ডেইলি প্যাসেঞ্জারিও করি।

প্রশ্ন: বেশ, তাহলে তো আমরা বাংলাতেই আড্ডা দিতে পারি।

শীর্ষা: একদমই।

প্রশ্ন: প্রথম ছবিই বলিউডের সুপারস্টারের সঙ্গে, কেমন লাগল বিদ্যা বালনের সঙ্গে কাজ করে?

শীর্ষা: আমি সত্যিই ভাগ্যবান। বিদ্যার অভিনয় নিয়ে কিছু বলার ক্ষমতাই নেই। তাই ওটা বাদই রাখছি। কিন্তু মানুষ হিসেবেও তিনি এত খাঁটি, নিখাদ, যে আড্ডা দিয়ে খুবই আরাম হবে। আমার প্রথম কাজ, প্রথম বড় ছবি। আর উনি তারকা। কিন্তু কখনওই এই দূরত্বটাকে উনি টের পেতে দেননি। সবসময় নজর রেখেছেন যাতে আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করি ওনাকে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে। আমি কী চাইছি না চাইছি, সেটা নিয়ে যেন বলতে কোথাও আটকে না যাই, বিদ্যা সেই পথটা খুব সুন্দর করে খোলা রেখেছিল। কারণ তিনি জানেন, ছবির ভালর জন্য সেটারই প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।

প্রশ্ন: ট্যানট্রাম, দাবি, চাহিদা, ইত্যাদির বালাই-ই নেই?

শীর্ষা: না! বরং সম্পূর্ণ উল্টোটা। আমি একদিন বলেছিলাম, চারদিন ধরে আমার বাড়িতে কাজের মাসি আসছেন না, বিদ্যা তার পরের দিনই আমার জন্য মাছের ঝোল বানিয়ে এনে দিলেন। এদিকে উনি কিন্তু তামিল ব্রাহ্মণ। ওঁর বাড়িতে মাছ হয় না। কিন্তু আমার জন্য সেটাও করিয়ে এনেছিলেন।

প্রশ্ন: বাঙালি মাছের ঝোল? বিদ্যা নিজেই বানিয়েছিলেন?

শীর্ষা: না সেটা ছিল প্রন কারি (চিংড়ি কারি)। উনি রান্না করতে পারেন না। ওঁর রাঁধুনি খুবই ভাল রান্না করেন। তাঁকে দিয়েই মাছের ঝোল রান্না করিয়েছিলেন।

প্রশ্ন: বিদ্যার তো প্রথম কাজ বাংলায়। আর এই ভাষাটার সঙ্গেও ওঁর যোগাযোগ রয়েছে খানিক। কতটা বাঙালিয়ানার চর্চা হল তাঁর সঙ্গে?

শীর্ষা: বিদ্যার বাংলা-প্রীতি প্রবল! আমার সঙ্গে মাঝে মাঝেই ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলেন। বাংলার সঙ্গে ওঁর যোগাযোগের সূত্রটা আরও ভাল বোঝা যাবে ওঁর বাড়ি গেলে। পুরো বাড়িজুড়ে সত্যজিৎ রায়ের ছবির পোস্টার, সত্যজিতের বিভিন্ন ছবি! ভাবতে পারেন? সত্যজিতের ভক্ত হিসেবে অনেক বাঙালিকে টেক্কা দিয়ে দিতে পারেন বিদ্যা।

প্রশ্ন: বিদ্য বালন এবং প্রতীক গান্ধি, এই জুটিটা কিন্তু বেশ ছকভাঙা। দু’জনের রসায়ন এবং অভিনয় খুবই প্রশংসিত হয়েছে। বাঙালি না হয়েও অনিরুদ্ধর চরিত্রে বেশ মানানসই।

শীর্ষা: হ্যাঁ প্রতীক এই ছবির সারপ্রাইজ প্যাকেজ। এর আগে ওঁর একমাত্র কাজ দেখেছিলাম ‘স্ক্যাম’। সেই প্রতীক আর এই প্রতীকের কোনও মিলই নেই। আগে আমরা কেবল বিদ্যার কাস্টিং লক করেছিলাম। সেই মতো বাকিদের খোঁজা হচ্ছিল। আমি চাইছিলাম, সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির দুই মানুষের প্রেম দেখাতে। বিদ্যাকে তামিল ব্রাহ্মণের চরিত্রে, আর তার একেবারে উল্টো বাঙালি চরিত্রে প্রতীক। বাঙালি না হয়েও খুব বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন তিনি।

প্রশ্ন: কিন্তু বাঙালি চরিত্রে অবাঙালি প্রতীক কেন?

শীর্ষা: এখানে একটা মজার গল্প আছে, প্রথমে আমি পঞ্জাবি চরিত্র হিসেবে লিখেছিলাম। কিন্তু প্রতীককে দেখে আমি চরিত্রটি বাঙালি হিসেবে তৈরি করি। ওঁর চেহারায় একটা প্রচণ্ড নিরীহ, ভাল ছেলের ভাব রয়েছে। আর সেটা বাঙালি ছেলের সঙ্গে যায়। সেখান থেকেই অনির চরিত্রটি তৈরি করা।

প্রশ্ন: নিখাদ প্রেমের ছবি হলেও আপনার ছবির মূলমন্ত্র ছিল, ‘বিবাহ আসলে একটি প্রতিষ্ঠান’…

শীর্ষা: আমি এই ছবির মাধ্যমে একটিই কথা আসলে বলতে চেয়েছি, প্রেম পরিবর্তিত হয়। বারবার বদলায়। প্রেম আসলেই বড় জটিল। প্রকৃতির নিয়মেই বারবার বদল আসে প্রেমে। আমাদের বাবা-মায়েরা বলেন, বিয়ে করে সেটেল হয়ে যাও। কিন্তু এই সেটেলমেন্টের মানেটা আসলে কী? আদৌ কি সেটেলমেন্ট বলে কিছু হয়? প্রেমকে চিরন্তন হতেই হবে, এমন জোরাজুরি কেন? আবার একইসঙ্গে প্রেম পুরনো হয়ে গিয়েছে মানে এটা নয় যে, সেটা প্রেম ছিল না। এই ছবির মাধ্যমে সেই অনুভূতিটাকেই ধরার চেষ্টা হয়েছে।

প্রশ্ন: আপনার বাংলায় এসে বাংলা ভাষায় কাজ করার ইচ্ছে হয় না?

শীর্ষা: খুব ইচ্ছে হয়। সুযোগ পেলেই আমি লুফে নেব। কারণ ওই যে বললাম, বাংলা আমার মাতৃভাষা। ওই ভাষাতেই আমি ভাবি।

প্রশ্ন: বাংলার কোন তারকার সঙ্গে কাজের ইচ্ছে?

শীর্ষা: আসলে আমি না ওইভাবে ভাবি না। চরিত্রের সঙ্গে মানানসই হলে আমি যে কোনও শিল্পীর সঙ্গেই কাজ করতে পারি। তারকা হোন বা না হোন। গল্পটাই আসল। গল্প এসে গেলে অভিনেতাকে নিয়ে ভাবি।

প্রশ্ন: কলকাতা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে মুম্বই ইন্ডাস্ট্রির মূল পার্থক্যটা কোন জায়গায়?

শীর্ষা: আমি কলকাতায় অনেক শ্যুট করেছি ঠিকই, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে কাজ করিনি কখনও। তাই পার্থক্য কতটা, সেটাও বুঝতে পারিনি এখনও। বাংলা কাজও খুব একটা দেখা হয়ে ওঠে না। তবে আমার বাবা-মা দেখে। ওঁরাই আমাকে বিভিন্ন তথ্য দেন।

প্রশ্ন: তাহলে আপনার কাছে বাংলা কাজ বলতে…

শীর্ষা: আমি বড় হয়েছি বাংলা সিনেমা দেখেই। সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে উত্তম-সুচিত্রার রসায়ন। এখনকার কাজ বরং দেখা হয়ে ওঠে না। এমনিতে বাংলার সেই যুগের ছবির ভক্ত আমি। আর আমার শিক্ষা, ছবি বানানো, সবের মধ্যেই তাই বাংলার ছোঁয়া ভরপুর রয়েছে আজও। এবং থেকেও যাবে চিরকাল।