এদিন দুপুরে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি থেকে বুদ্ধবাবুর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় পিস ওয়ার্ল্ডে। সেখানেই শায়িত রয়েছেন প্রবাদপ্রতিম রাজনীতিবিদ কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শুক্রবার তাঁর শেষ যাত্রা। আনুষ্ঠানিক ভাবে ও সরকারি তরফে প্রিয় কমরেডকে জানানো হবে চিরবিদায়।

Buddhadeb Bhattacharjee: তিনিই মিথ, তিনিই ‘মুখ’! রূপকথা থেকে শোকগাথা-বিদায় বুদ্ধদেব

কলকাতা: নাকে তাঁর অক্সিজেনের নল। ডান পাশে স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য। অক্সিজেনের চ্যানেল নিয়েই দু-দু’বার গাড়ি থেকে নামার চেষ্টা করলেন তিনি। সিপিএম কর্মী ও পুলিশ অফিসারদের হুটোপুটিতে তখন ধূলিসরিত ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে আরও ধুলো উড়তে শুরু করেছে। জটিল শ্বাসকষ্টের অসুখে আক্রান্ত ভগ্নস্বাস্থ্যের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেই ধুলোর মধ্যে পারলেন না গাড়ি থেকে নামতে। ব্রিগেডে মঞ্চের ঠিক পিছনে এ ভাবে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট থাকলেন। তবু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এসেছেন, এই ‘খবর’ ছড়িয়ে পড়তেই মঞ্চের পিছনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল মঞ্চের সামনের লাখো হৃদয়ে, লাল সমুদ্রে। সেই শেষ, সেই শেষ চেষ্টা, আর দলের সভা-সমাবেশে ‘আসতে’ পারেননি তিনি। ২০১৯ থেকে ২০২৪ – বদলে গেল কত’কিছুই। কিন্তু পাম অ্যাভিনিউ-র অপরিসর সিঁড়ি ধরে নেমে আসছেন সেই সাদা ধুতি-পঞ্জাবির মানুষটা, এই অভাববোধে আর কোনও বদল এল না। চেয়েছেন বারবার, অশক্ত শরীরেও ডাক দিয়েছেন ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’। কিন্তু তিনি নিজেই যে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারলেন না অসম শরীরী যুদ্ধে, পারল না তাঁর দলও।

সিপিআইএম মানেই ‘দল’, সিপিআইএম মানেই ‘সংগঠন’, আলাদা করে ‘ব্যক্তি’র পরিসর নেই দলে, নেই ‘মুখে’র ক্যারিশমাও। বাম দলের এই বহুচর্চিত নীতি শেষদিন পর্যন্ত মননে নিয়েই বেঁচেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাই কখনও ‘আমি’ নয়, বারবার তাঁর কণ্ঠে উঠে এসেছে ‘আমাদের’ কথা। ‘আমরা-ওরা’ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখেও তিনি স্থিতধী থেকেছেন, কারণ ‘বিভাজন’ তাঁর ‘ধর্ম’ ছিল না কোনওকালেই। কাস্তে-হাতুড়ির দলীয় অনুশাসনেও তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ব্যতিক্রমী তারা, আলাদা ‘মুখ’।

আরও পড়ুন: অসাধারণ এক পোর্টফোলিও হয়েও সারাজীবন সাধারণ থাকলেন বুদ্ধ-জায়া মীরা…

এ বছরই ব্রিগেড সমাবেশে বুদ্ধদেবের বার্তা পাঠ করা হয়েছিল। বুদ্ধদেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিপিআইএম-এর বর্তমান প্রজন্মের ‘ক্যাপ্টেন’ মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘‘উনি চিরকাল আমাদের কাছে শক্তি এবং আবেগ। উনি আমাদের হাত ধরে বলেছেন, বড় ব্রিগেড হবে। ভাল ব্রিগেড হবে।’’ আসলে ২০১১ ইস্তক ‘ভাল’র সংজ্ঞা হারানো সিপিআইএম-এর কাছে সেই তিনিই ছিলেন ‘রক্ষাকবচ’, অস্তমিত সূর্যের শেষ লালটিকা।

তবে, দলের অন্দরের কাঁটাছেড়া থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লাগামহীন বিরোধিতায় বারবার ফালাফালা হয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাপসী মালিক হত্যা থেকে বারাসতের রাজীব দাস হত্যাকাণ্ড, বাম শাসনের শেষ লগ্ন যত এগিয়েছে, ততই বিদ্ধ হয়েছেন বুদ্ধদেব। ‘স্বচ্ছ ভাবমূর্তি’র উৎকৃষ্ট উদাহরণ যিনি, তাঁর দিকেই উঠেছে একের পর এক অভিযোগের আঙুল। সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের অধ্যায় সেই স্বচ্ছ ‘শাসকের’ বিদায়কে ত্বরান্বিত করেছিল, এই যা।

যে মানুষটি দলীয় অনুশাসনের তোয়াক্কা না করেই বলেছিলেন, ‘চোরেদের মন্ত্রিসভায় থাকব না!’, সেই মানুষটির দুর্নীতি-হীন ‘ইমেজ’ নিয়ে বাক্যব্যয় শব্দের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তেমনই জ্যোতি বসুর মতো ‘জননেতা’র তকমা না পেলেও ‘ক্ষমতাহীন’ সিপিআইএম-এর তিনিই ছিলেন সঞ্জীবনী টিকা। তাই তাঁর সামান্য অসুস্থতার খবরে ছুটে এসেছেন গ্রাম উজিয়ে মানুষ, বাম-ডান সব দলের নেহাতই কর্মীর মুখে শোনা যেত, ‘উনি ভাল হয়ে উঠুন।’

ভাল আর হয়ে ওঠা হল না। খাদ্য আন্দোলন থেকে যাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি, ধারা অব্যাহত রেখেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি থেকে গেলেন পাম অ্যাভিনিউর স্যাঁতস্যাঁতে ছোট্ট ঘরে, চাহিদা-শূন্য পৃথিবীর বুকে। কী পেতে পারতেন, সেই হিসেবের খাতা খুললেনই না কোনওদিন, বরং বর্জনেই অর্জন খুঁজে নিলেন বুদ্ধদেব। নির্বাচনী রাজনীতিতে ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিত হতে চলা সিপিআইএম-এর প্রাসঙ্গিক ‘আইকন’ তাই তিনিই। অন্তরালে থেকেও রয়ে গেলেন সূর্যের মতো প্রবল, আলোকিত নক্ষত্র। রূপকথা থেকে শোকগাথা- একটাই তো নাম, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য!