#কলকাতা: সুশান্ত সিং রাজপুত ৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় যেন এক বিপ্লবের নাম৷ তাঁর মৃত্যু আরও স্পষ্ট করেছে লাইমলাইটের পিছনের অন্ধকারকে ৷ তদন্তে একে একে সামনে আসছে নানা মত, নানা তথ্য, নানা সমীকরণ ৷ তবে এরই মাঝে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটাই প্রশ্ন, ‘ব্রিলিয়ান্ট’রা কী আর স্বপ্ন দেখবে বলিউডে পা রাখার? সুশান্ত সিং রাজপুতের এরকম পরিণতি কি ভাবাচ্ছে তাঁদের? — উত্তর খুঁজলেন শর্মিলা মাইতি
পঞ্চাশ দিন কেটে গেল, এখনও লক্ষ মানুষের মনে কী যেন একটা শূন্যতা খচখচ করছে! কী যেন একটা নেই। সুশান্ত সিং রাজপুতের এই হঠাৎ চলে যাওয়াটা একটা অস্বস্তি, একটা প্রশ্ন যা মধ্যবিত্ত মনের ওই নিঃশব্দ, নিশ্চুপ জায়গাটা দখল করে বসে আছে, কিছুতেই যাচ্ছে না। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই সুশান্তের প্রাণবন্ত ভিডিও, প্রাণভোলানো হাসি, দিল বেচারার ছোট্ট ছোট্ট টুকরো, কিছুই ভুলতে দিচ্ছে না, তাই না?
মনে হচ্ছে, প্রাণ আছে, এখনও প্রাণ আছে।
প্রথমে প্রশ্নটা শুরু হযেছিল ‘কেন’ দিয়ে ৷ এক বিরাট জিজ্ঞাসাচিহ্ন যা করোনার সঙ্কটটাও ভুলিয়ে দিয়েছিল কিছুকালের জন্য ৷ স্বয়ং বচ্চনসাব ছ’বার ‘কেন’ শব্দটা লেখার পর অবিচুয়ারি লিখেছেন ব্লগে।
এ মৃত্যুসংবাদটা কোথাও যেন মধ্যবিত্তের 2BHK ফ্ল্যাটে গিয়ে কড়া নেড়েছে। সেফটি লকারে হাত দিয়েছে। ভয় ধরিয়েছে। সাফল্যের ‘মই’টা ধরাশায়ী করে দিয়েছে! সাফল্যের চুড়োর সংজ্ঞাটা যে অনেক কষ্ট করে শেখা, তাতে খাপে খাপে মিলে যায় সুশান্ত সিং রাজপুত নামটা, আমজনতার হিরো! কী ছিল না তাঁর? অসম্ভব সুন্দর তীক্ষ্ণ চেহারা, আবেদনে ভরা চোখ, অভিনয়ে ‘শুইয়ে’ দেবেন আচ্ছা-আচ্ছা নামদেরও, খোদ অক্ষয়কুমার ঈর্ষান্বিত হয়েছেন। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ছিল যা, তাতে তিন পুরুষ আরামে চলে যাবে।
ছবির অফার, ওয়েবসিরিজের অফার ছিল, কোটি কোটি টাকার ডিল ছিল, বান্দ্রায় আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্ট ছিল, চাঁদে কেনা জমি ছিল, তবু সুইসাইড! ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে। কেন, কিছুতেই কেন হিসেবটা মিলছে না…তার কিছুদিন আগেই চিরতরে বিদায় নিয়েছেন ইরফান খান, ঋষি কাপুর। ফিল্মোগ্রাফি যাঁদের বিরাট লম্বা ৷ কিন্তু সুশান্তের মৃত্যু যেন ঝোড়ো সাইক্লোন! সব ঢেকে দিল। ঠিকমতো দুঃখপ্রকাশের সময়টাও দিল না। এই প্রতিবেদনটি যখন লেখাহচ্ছে, তখন ‘কেন’-র সংখ্যা চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে গিয়েছে. কোটি কোটি জনরোষ জমা পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, ঝড় উঠেছে তারকা সন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নিয়ে, কাদা ছোড়াছুড়ি থেকে বিষোদগার, কোনওটাই বাকি রাখেনি। ততদিনে এতে রাজনীতির রং লেগেছে। বিহার পুলিশের সঙ্গে মুম্বই পুলিশের ধুন্ধুমার বেধে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার অবশেষে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
‘জাস্টিস ফর সুশান্ত ‘ হ্যাশট্যাগ অবশেষে সফল বলে উল্লাস করছেন জনগণ আর ওদিকে আরও অনেকটা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে সুশান্তের ‘ মধ্যবিত্ত’ পরিবার।
বলিউডে কোনও মৃত্যুই এখনও অবধি এতটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর কারণ হিসেবে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরেও একটা বিরাট জনমত কার্যকর। যারা বার বার দেখতে পাচ্ছে, কাই পো চে কিংবা ধোনি দ্য আনটোল্ড স্টোরির সুশান্তকে নয়, একটা তুখড় বুদ্ধিধর ছেলে, মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের ‘হিরের টুকরো’কে। যে ছেলেটা তুড়িতে অঙ্কের জটিল সমাধান করতে পারে, সাত-সাতটা ইঞ্জিনিয়ারিং এনট্রান্স ‘ক্র্যাক’ করতে পারে, ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে ন্যাশনাল লেভেলে বাজি মারতে পারে, মোদ্দা কথা এমন এক ‘পড়াশোনায় ভাল’ ছেলেকে এমন দুয়ো দিল বলিউড? কত বড় স্পর্ধা! বারো ক্লাস না পেরনো, পেটে গুঁতো মারলেও কিছু বেরোবে না এমন কতগুলো আকাট, বাপের পয়সায় বড়লোক ছেলেপুলে নিয়েই তো তৈরি ওই জগতটা। ঠিক এখানেই বড়সড় একটা অন্তর্মুখী লড়াই… সুশান্ত কোনও বিশেষ অভিনেতা হয়ে থাকেন না, হয়ে যান ‘আমাদেরই লোক’৷ যার বাবার সাতমহলা বাড়ি ছিল না, বিএমডব্লু ছিল না, ছিল আমার আপনার মতোই মোজেইকের মেঝে। সাধারণ সোফাসেট। কুরুশের কাজ করা ঢাকনা দেওয়া।
চার বোনের এক ভাই সুশান্ত এই বাড়ি থেকেই তো পড়াশুনো করেছে, পাল্লা দিয়ে জয়েন্টে পেয়েছে, এসবের পরে বিদেশে বড় কোম্পানিতে চাকরি করতে পারত, আরও কত উন্নতির রাস্তা বাঁধা ছিল… তা না করে বলিউড পাড়ি? এমনও কি হয়? ব্রিলিয়ান্ট ছেলেদের কি বলিউড ভাবতে আছে … সিনেমা দেখে রিল্যাক্স করো, ঠিক আছে, হিরো’ হয়ে নাচানাচির স্বপ্নটা কি মেলানো যায় ওই ক্যাটাগরির সঙ্গে? ‘হিরো’তো হতে যাবে তারাই, যারা এই বিপুল জ্ঞানের জগতে ‘হেরোপার্টি’। লাস্টবেঞ্চার। যাদের লাইফে ‘অন্য কিছু’ হওযার নেই।
এ কথা বললে অনেকেই বিরোধিতা করবেন, কিন্তু ২০২০ সালে এসেও নব্বই ভাগ মধ্যবিত্ত এখনও সেফ চাকরির স্বপ্নের আফিমেই বুঁদ করে রাখতে চান উত্তরসুরিদের ৷ সেখানেই সুশান্ত এক ছকভাঙা সাহস ৷ এক বুক ঝড় ৷ সুশান্ত ওই টিপিক্যাল স্বপ্নটাকে ভুল প্রমাণ করেছিল। পর পর ‘সফল’ হয়ে দেখিয়েছিল, ট্র্যাক চেঞ্জ করেও ফিনিশ লাইনে পৌঁছনো যায়। জয়োল্লাস করা যায়। খুব কাছের মানুষেরা জানতেন, সুশান্তের বিজ্ঞানচেতনাই নয়, উর্দু কবিতাও তিনি আবৃত্তি করতেন স্বচ্ছন্দে।
আদতে অসম্ভব ডিসিপ্লিনড, প্রতিদিনের টু-ডু লিস্টে বই পড়া ছিল মাস্ট। রাতে ৫৫ লক্ষ টাকা দিয়ে কেনা টেলিস্কোপে চোখ রেখে নক্ষত্রের গভীরতায় ডুব দেওয়া ছিল অভ্যেস।
বলিউডে সবার চেয়ে আলাদা একমাত্র সুশান্ত যিনি কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতে পারতেন। ডিগ্রী সাজানো নয়, মেধায় অবিরত শান দেওয়া ছিল তাঁর কাছে জল-ভাত। প্রতিদিনের অনুশীলন।
একমাত্র সুশান্ত যিনি জিম-ফিটনেস-অভিনয়-স্টান্টের বাইরেও, সারাজীবন ছিলেন এক জ্ঞানপিপাসু মনোযোগী ছাত্র। চিরকিশোর। মেধা আর গ্ল্যামার যে বিবাহিত দম্পতির মতো একসঙ্গে পাশাপাশি থাকতে পারে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ একমাত্র তিনি। অভিনয় তাঁর একটা বিশেষ গুণ মাত্র।
কী শেষ করল, কে শেষ করল সুশান্ত সিং রাজপুতকে? তার উত্তর খুঁজুক সিবিআই৷ আসলে হত্যা না আত্মহত্যা, তা অনুসন্ধানের গুরুভার এখন সিবিআইয়ের হাতে… কিন্তু মধ্যবিত্তের সযত্নে লালিত স্বপ্নটার কী হবে এবার? লেখাপড়ায তুখড় ছেলেরা কি এতটুকু বলিউড স্বপ্ন দেখলেও, তা পূর্ণ করার সাহস করতে পারবে… নাকি থেকে যাবে চাকরি-প্রোমোশন-ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ট্র্যাকে? জীবনভর সেই ট্রাকেই দৌড়বে, তাদের সন্তানদেরও একই ট্র্যাকে দৌড়তে বলবে? সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুই একটা মস্ত বড় পরাজয়। একটা অসাধারণ স্বপ্নভঙ্গ। নেপথ্যের ‘কেন’-টা ইম্পর্ট্যান্ট নয়। বাইরের চ্যাঁচামেচি মাত্র। ভিতরের প্রদীপটা কখন নিভেই গিয়েছে।