Lajja Web Series Review: লজ্জা, তুমি কার? ওদের না আমার?

লজ্জাকে নারীর ভূষণ বানিয়ে অচিরে বহু আগেই হাত ধুয়ে ফেলেছে সমাজ। আর সেই ভূষণের চোখ ধাঁধানো ছটায় কালক্রমে হারিয়েছে তাদের চাওয়া-পাওয়া, অস্তিত্বের লড়াই, নিজেদের প্রাপ্যটুকু ছিনিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম। পুরুষ তথা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ-রাষ্ট্রের এঁকে দেওয়া লক্ষণরেখা পার করলেই আসে ভর্ৎসনা, কুৎসা। ক্ষেত্রবিশেষে চরিত্রহননও। মৌখিক নিগ্রহ থুড়ি ‘ভার্বাল অ্যাবিউজ’ যাদের নিত্যসঙ্গী, গালিগালাজ, ব্যঙ্গ যাদের হজমিগুলির মতোই গিলে ফেলতে হয়, তাদের জীবনের মন্তাজে লজ্জার ভাগ কতটা? হইচই-এর নতুন ওয়েব সিরিজ ‘লজ্জা’ সেই প্রশ্নই আরও একবার উস্কে দিল।

নির্যাতন শুধু শারীরিক নয়। নিছক শব্দাঘাতেও তিলে তিলে শেষ করে দেওয়া যেতে পারে মানুষকে। কথার নিষ্ঠুরতায় ভেঙে চুরমার করে দেওয়া যায় মনোবল। নিছক দু’এক বাক্যের মারপ্যাঁচে কী অনায়াসেই পিঠ ঠেকিয়ে দেওয়া যেতে পারে দেওয়ালে! দাঁত-নখ বার করে লড়াই চালিয়ে অবশেষে যখন ঘুরে দাঁড়ানো যায়, তখন সামনে শুধুই অন্ধকার, তলিয়ে যাওয়া। আমাদের চারপাশে এমন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নারীর সংখ্যা নেহাতই কম নয়। সিরিজটি মুক্তি পাওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় অগুন্তি পোস্ট, কমেন্ট বলছে, এই নির্যাতিত, নিপীড়িতরাই আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেই তিক্ত বাস্তবকেই সযত্নে সিরিজে তুলে ধরেছে হইচই। প্রশ্ন তুলছে, ভাবতে শেখাচ্ছে, ঠিক কোথায় গিয়ে ইতি টানা উচিত।

অদিতি রায়ের সাবলীল পরিচালনা, সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি, সংলাপ এবং চিত্রনাট্যের মুন্সিয়ানায় ‘লজ্জা’ যেন নারীজীবনেরই প্রতিফলন। এই কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জয়া (প্রিয়াঙ্কা সরকার)। নরম স্বভাবের, নির্বিরোধী জয়ার নিত্যসঙ্গী স্বামী পার্থর (অনুজয় চট্টোপাধ্যায়) অপমান, অবহেলা, ব্যঙ্গ। বাবার দেখাদেখি মেয়ে শ্রুতিও মাকে তাচ্ছিল্যের নজরে দেখে। শাশুড়ি (খেয়ালী দস্তিদার) সকলের সামনে বৌমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও কথা দিয়েই প্রতি মুহূর্তে ভেঙে খানখান করতে চায় তাকে।

বিত্তশালী পরিবারে কোনও কিছুরই অভাব নেই। আর্থিক বৈভবের জাঁকজমকে শুধু নিজেকে ভালবাসার তাগিদটুকু হারিয়েছে জয়া। তার অসহায়তা পর্দায় যথার্থ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রিয়াঙ্কা সরকার। জয়ার বিপন্নতা, লড়াই, আবেগের টানাপড়েন, সবটাই বেশ বিশ্বাসযোগ্য। সিরিজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুব গতে বাঁধা ঘটনাক্রমেও তাই তার সমব্যথী হয়ে ওঠা যায়। একেবারে ক্লিশে খারাপ মানুষের চরিত্রে পুরো নম্বর ছিনিয়ে নেন অনুজয়। বেশ কিছু দৃশ্যে তাঁকে দেখে প্রবল ঘৃণার উদ্রেক হয়। টক্সিক মাস্কুলিনিটির ধ্বজাধারী পার্থর চরিত্রে প্রিয়াঙ্কার সাবলীল অভিনয়কে টক্কর দিয়েছেন। শাশুড়ির ভূমিকায় স্বল্প পরিসরে নজর কেড়েছেন খেয়ালী।

জয়ার লড়াইয়ে তার সঙ্গী হয়ে ওঠে দুই মানুষ। সহকর্মী মৌ এবং তার উকিল-বন্ধু শৌর্য। গুরুত্বপূর্ণ দুই ভূমিকায় মনজয় করেন শাঁওলি চট্টোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রাশিস রায়। সহমর্মী বৌদির চরিত্র যথার্থ ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন স্নেহা চট্টোপাধ্যায়।

কঠিন পরিস্থিতিতে মনের অসুখ হলে সাহায্য চাওয়ায় লজ্জা নেই। বরং তা-ই তো কাম্য! সিরিজের জরুরি এই বার্তাও দেওয়া হয়েছে। তবে মনোবিদের ভূমিকায় উল্লেখযোগ্য কিছুই করার পরিসর পেলেন না কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতো পোড় খাওয়া অভিনেত্রীকে আরও বুদ্ধি করেই কাজে লাগানো যেত বলে মনে হয়। জয়া এবং তার মনোবিদের কথোপকথন আরও কিঞ্চিৎ পরিণত হতে পারত।

সিরিজের বিষয়বস্তু যখন মৌখিক নিগ্রহ, সেই ভারে স্বাভাবিক ভাবেই মেকিংয়ের মতো প্রযুক্তিগত বিষয়গুলি খানিক গৌণ হয়ে পড়ে। তবে ‘লজ্জা’ চিত্রনাট্যে সব চরিত্রই যেন বড় বেশি সাদা-কালো। ধূসরের কোনও স্থানই নেই সেখানে। চরিত্রগুলির মধ্যে আরও কিছু স্তর থাকলে বোধহয় তা জীবনের আরও কাছাকাছি হত। তবে বিবাহিত মেয়ের বাড়ি ফিরে আসা নিয়ে মায়ের প্রবল সংশয়, দিদির বিপন্নতায় বোনের চাপা উচ্ছ্বাস, টুকরো টুকরো এই জিনিসগুলি বাস্তব থেকে ধার করে বড় ক্যানভাসে ফেলে যেন ক্ষয়িষ্ণু সমাজব্যবস্থার ছবি তুলে ধরেছেন পরিচালক।

গেরস্তের তথাকথিত সংসারী মহিলার জন্য নিজেকে ভালবাসা, সম্মান করা যেন কষ্টকল্পিত এক বিলাসিতা। তাদের ভাগে বরাদ্দ সন্তানজন্ম এবং পালন, রান্নাঘর, আর সংসারের চার দেওয়াল। তাই সেই গণ্ডি পেরিয়ে শুধুমাত্র নিজের তাগিদে কিছু করার, নিদেনপক্ষে নিজের ইচ্ছা মতো পোশাক পরার ‘দুঃসাহস’ প্রদর্শনেও মেলে গালিগালাজ, কটাক্ষ। স্বাধীনচেতা নারীকে অকথ্য সব বিশেষণে ভূষিত করার প্রথাও নেহাত নতুন নয়।

এই সিরিজেও ফুটে ওঠে এমন সব ঘটনার বিমর্ষ কোলাজ। বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তরাঁয় খেতে গিয়ে অপমানিত হয় জয়া। পরকীয়ার অভিযোগ এনে তাকে সকলের সামনেই কাঠগড়ায় তুলে দেয় স্বামী পার্থ। স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে একবারও দ্বিধা হয় না তার। সকলের সামনেই চলে যথেচ্ছ গালিগালাজ। আবার কর্মক্ষেত্রে জয়ার সহকর্মী ভার্বাল অ্যাবিউজ নিয়ে সরব হলেও মেলে না কোনও সাহায্য। আসলে শুধু ঘরেই নয়! সংসার-সংগ্রামের কাঁটা পেরিয়ে বাইরের পৃথিবীটাও নারীদের জন্য একই রকম নিষ্ঠুর। বন্ধুর। অনেক সময়ই দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে পুরুষ কর্মীটির তুলনায় মহিলা কর্মীটি বেশি বেতন পেলেই শুরু হয় রসালো চর্চা। তাতেও পরিতুষ্ট না হলে কদাকার সব তত্ত্বের উদ্ভাবন। বসের সঙ্গে বিশেষ খাতিরের সুবাদেই কি বাড়তি সুবিধা? সুন্দরী বলেই কি যা প্রাপ্য, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি পেয়ে যাওয়া? এমনই সব প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসে নারীর দিকে। তার যোগ্যতা, পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, এ সবই তখন গৌণ। নারীর সাফল্য যেন অচিরেই মেপে নেওয়া যায় তার মুখশ্রী, শরীরের গড়ন আর বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের নিক্তিতে। হেসে কথা বললে, সে ‘গায়ে পড়া’। আবার দূরত্ব বজায় রাখলেও সে ‘দাম্ভিক’। অন্যায়ের প্রতিবাদে সরব হলে নারী ‘মুখকাটা’, ‘ডিফিকাল্ট’। চুপ করে থাকলেই সে ‘আশকারা’ দেয়। বুক থেকে সামান্য আঁচল সরে গেলেই নাকি পুরুষকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা। আবার রেখেঢেকে পোশাক পরলেই নারী ‘ব্যাকডেটেড’।

স্বামীকে চমকে দিতে জয়া যখন খানিক খোলামেলা রাতপোশাক পরে আসে, তার ভাগে জোটে গালিগালাজ। কোনও বিষয়ে স্বামীর সঙ্গে সহমত না হলেই প্রকাশ্যে অপমান। এনজিও-তে স্ত্রীর স্কিল ডেভেলপমেন্টের চাকরি মোটা মাইনে পাওয়া স্বামীর কাছে শুধুই হাসির খোরাক! ক্রমাগত অপমান সইতে থাকা জয়ার মানসিক বিপর্যয়কে অচিরেই পাগলামি হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হয়। অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে আদালতে যেতে চাইলে, ‘লোকে কী বলবে’-র ভয় ঘিরে ধরে তাকে। প্রতি পদেই যেন অদৃশ্য কোনও প্রতিরোধ গড়ে উঠছে জয়ার বিরুদ্ধে। কাছের মানুষরাই তার যাপন, বিশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে বারবার।

আরও পড়ুন: শ্রেয়া, অরিজিৎ, নেহা নস্যি! একটি গানের জন্য সবচেয়ে বেশি আয় কার, জানেন কি

আরও পড়ুন: শ্রেয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী! একটি গানের জন্য কত টাকা নেন সুনিধি, অঙ্কটা অবাক করার মতো

‘মেয়েমানুষ’ যা-ই করেছে, আতসকাচের তলায় তা নিয়েই চলেছে বিস্তর কাটাছেঁড়া । পিতৃতন্ত্রের ধার্য করা নিয়মের বাইরে যেতে চাইলেই তাকে টেনে নামিয়ে দেওয়ার কী প্রবল চেষ্টা! প্রাণে যদি না-ই মারা যায়, কথা দিয়েই বারবার নগ্ন করা হয়েছে নারীকে। তাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে খাদের কিনারায়। কখনও আবার নিছক ইয়ার্কির আড়ালেই তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ঠিক যে ভাবে জয়ার ছবি আঁকার প্রতিভাকে সকলের সামনে ‘কিছুই না’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে তার স্বামী। চুপচাপ অপমান গিলে নিলেই নারী লক্ষ্মীমন্ত। কিন্তু নিজেকে আগলাতে দাঁত-নখ বার করলেই, সে দোষী, চরিত্রহীন। মৌখিক নিগ্রহের বিরুদ্ধে গলা তুললেই চট করে গায়ে জুড়ে দেওয়া হয় ‘ওভার সেনসিটিভ’ তকমা। তথাকথিত সচেতন সমাজে পান থেকে চুন খসলেই প্রতিবাদ হয়, মিছিল বেরয়, গান বাঁধা হয় প্রতিরোধের। কিন্তু নারী মনের কথা বলতে চাইলে? চোখে ঠুলি, কানে তুলো! তা হলে লজ্জাটা আসলে কার? চোখ-কান বুজে বিষাক্ত পৌরুষের উদযাপনে মেতে থাকা মানুষগুলোর না কি ‘মেয়েমানুষ’-এর? ভাবার সময় এল কি? সেই প্রশ্নই যেন নতুন করে তুলে দিল ‘লজ্জা’।