Chamkila Amar Singh Review: শুদ্ধবাদী আর সাংস্কৃতিক মৌলবাদী দর্শক ইমতিয়াজের কড়া ডোজ হজম করতে পারলে হয়!

বিচিত্র এ দেশ, বিচিত্র তাঁর সংস্কৃতি! দেশের পশ্চিমপ্রান্তের পঞ্জাব প্রদেশ৷ বলিউডের গল্পদাদুর আতুরঘর৷ সেখানে কত সুপারহিট, ব্লকবাস্টারের জন্ম, একরাতে গুণে বোধহয় শেষ করা যাবে না৷ কিন্ত ইমতিয়াজ আলি পরিচালিত ‘অমর সিং চমকিলা’ বোধহয় ভাঙা সাইকেলে স্কুলে আসা অঙ্কের সেই মাস্টারমশাইয়ের মতো, যাকে দেখে বোঝা যায় না, তিনি চাইলে আরামসে বিজ্ঞানী হতে পারতেন, নিদেনপক্ষে সরকারি রাশিবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ তো হতে পারতেনই৷ বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, আপাত নিরীহ লুকের এই ছবি আসলে কোনও সিনেমাটিক জাগলারি দেখানোর জন্য তৈরি করা হয়নি, তৈরি হয়েছে ইতিহাসের এক বিশ্লেষণের তাগিদ থেকে৷

শিল্পের ভাষা কেমন হবে? যে র‍্যাপ গায়ক বিক্ষুব্ধ কাশ্মীর বা ধ্বংসপ্রাপ্ত প্যালেস্তাইনের বস্তি থেকে উঠে এসেছেন, দিনরাত ধর্ষণ দেখেছেন, দেখেছেন মাথা কেটে রাস্তায় ছড়িয়ে দেওয়া বা বিনা দোষে তল্লাশির নামে ধর্ষণ কিম্বা হত্যা, তাঁর ক্ষোভ কোথায় লুকিয়ে থাকবে? শিল্পে নয়? যে ছোটবেলা থেকে সমাজ নির্ধারিত ‘অপশব্দ’ শুনেছে, সে সন্মোধনের প্রামাণ্য ভাষা হিসাবে জেনেছে চারঅক্ষর বা দু’অক্ষর, সে কী ভাষায় কথা বলবে শিল্পের সঙ্গে, বঙ্কিমী বাংলায়?

শিল্প উত্তীর্ণ কখন হয় কোনও সৃষ্টি? এর আদত কোনও গ্রন্থগ্রাহ্য সংজ্ঞা আছে? নেই৷ কিন্তু শিল্পের উৎকর্ষের সঙ্গে জনপ্রিয়তার একটা ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কের কথা মেনে নেওয়া চলে৷ বিরোধিতা থাকলেও আপাতত এই জনপ্রিয়তা ও উৎকর্ষের সূত্র এই লেখার স্বার্থে মেনে নিন। তাহলে কি জনপ্রিয় মাত্রই নিম্নমানের? ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে তাই। রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, চিত্তপ্রসাদ বা যামিনী রায়, বাঙালি জীবনে নাম বটে, সব শ্রেণির মানুষের কাছে শ্রদ্ধেয় বটে, কিন্তু জনপ্রিয় নন, কোনওদিন হবেনও না। জনপ্রিয় টুনির মা, জনপ্রিয় বেদের মেয়ে জ্যোস্না। অসংখ্য রাজনৈতিক গলদ নিয়েও এগুলি জনপ্রিয়, কারণ গণমানস কখনই শিল্পবোধের ধারক নয়,বরং তাদের কাছে শিল্প মানে অবসর এবং এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট। জনপ্রিয় তাই মূল ধারা, আদিতেও ছিল, হাজার বছর পরেও থাকবে।

সেই জনপ্রিয়তার ধারা থেকেই পাঞ্জাবি দলিত পরিবারে জন্ম নেওয়া এক শিল্পীর গল্প চমকিলা। দলিত, পঞ্জাবি এক সন্তান, যে ভাবে, শিল্পী হবে, সে ছোটবেলা থেকে জানে, আখড়ায় চটুল গান গেয়ে হাততালি আর পয়সা কমানোর নামই সংগীতশিল্প। ছোটবেলায় জুতোর বাড়ি খেয়েও তাই গান গাওয়ার স্বপ্ন সে ছাড়তে পারে না। তার পর কয়েক বছরের মধ্যে উল্কার মতো উত্থান, তার পর, ফসল ভরা মাঠের পাশে গুলি খেয়ে পড়ে থাকা। ৮-৯ বছরের জীবন ফিনিশ পঞ্জাবের জনপ্রিয়তম শিল্পীর। এই হল সিনেমার গল্প। ছবিতে প্রশ্নাতীত সাফল্যে সঙ্গীতের কাজ করেছেন এআর রহমান৷ অসম্ভব সুন্দর মোহিত চৌহান আর অরিজিৎ সিংয়ের গান দু’টি! দিলিজত দোশাঞ্জকে পাগড়ি ছাড়া দেখতে পাওয়ার প্রথম ঝটকা কাটিয়ে উঠলে বোঝা যায়, প্রায় অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি৷ পরিণীতা চোপড়াকেও মানানাসই লেগেছে৷ আসলে এগুলো সাধারণ, গল্পের শক্তি এইসবকে সাধারণ করেছে৷ এঁরা দু’জনেই অভিনয় করেছেন, গানও গেয়েছেন৷

ছবির প্রচারে, পিটিআই-এর ছবি
ছবির প্রচারে, পিটিআই-এর ছবি

কিন্তু কেন এই সিনেমা গুরুত্বপূর্ণ? ইমতিয়াজ আলি এর থেকে ঢের শক্তিশালী সিনেমা আগে বানিয়ে ফেলেছেন৷ ইমোশনের দিক থেকে, মেকিংয়ের দিক থেকে অনেক, অনেক শক্তিশালী ছবি তাঁর লেন্সে ধরা দিয়েছে৷ তাই সিনেমার বিচারে এটাকে দেখলে হবে না, বরং এটাকে দেখতে হবে অন্যভাবে৷ দেখতে হবে বায়োগ্রাফির মতো করে৷ উল্লেখযোগ্য ভাবে, ইমতিয়াজ এই ছবিতে কোনও ভাবে অমর সিংকে বাস্তবের মাটি থেকে তুলে আইফেল টাওয়ারে বসাননি৷ বরং তিনি তাঁকে মাটিতেই রেখেছেন৷ খ্যতির চূড়ান্ত ধাপেও, রেখেছেন একেবারে মাটিতেই৷ কারণ, অতিরিক্ত স্লো-মোশন, বিরক্তিকর মোমেন্ট তৈরি করে ইমোশনাল সুড়সুড়ি দিয়ে এ দেশের বীরাপ্পানকেও নায়ক বানাতে পারে একমাত্র সিনেমাই, কিন্তু এক্ষেত্রে সেই চেষ্টাই করেননি ইমতিয়াজ৷ শুধু একটা লিনিয়ার ন্যারেটিভ তৈরি করতে চেয়েছেন, বাকিটা ছেড়ে দিয়েছেন দর্শকদের উপরে৷

আরও পড়ুন – কেন কুড়ি ফুট নিচে পড়ল বাস? ঠিক তখন কী করছিল চালক? জানলে শিউরে উঠবেন

পঞ্জাবের আকাশে মেঘ করে এলে, সেই মেঘে কোথাও একফোঁটা চমকিলা মেশানো থাকে কি না, সম্প্রতি একটি কমেডি শোয়ে এই ছবির প্রমোশনের উদ্দেশ্যে আগত তারকাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সেই শোয়ের উপস্থাপক কপিল শর্মা৷ তিনি বলেছেন, আমরা সকলেই ছোটবেলা থেকে চমকিলার কথা শুনেছি৷ একেবারে বাচ্চা থেকে বুড়ো, সকলেই চমকিলাকে চেনে, চমকিলার গান শোনে, চমকিলার কথায় নাচে, আর এগুলো তে মিথ্যে হয়ে যায় না৷ এখানেই বোধহয় তাঁর সাফল্য৷ সে কাউকে আক্রমণ করেনি, কাউকে ক্যানসেল করেনি, শুধু নিজের পথে চলেছে, লোকে শুনেছে, কেউ ভাল বলেছে, কেউ মন্দ বলেছে, শেষে কেউ মেরে দিয়েছে৷ আর এই মেরে দেওয়ার বিষয়েই যে আপত্তি, তাতেই উঠছে মৌলবাদের মৌলিক প্রশ্ন, যার রক্তের দাগ আমাদেরও কম নেই৷

বাঙালির একটা আদত সমস্যা আছে৷ সে কিছুতেই এখনও উনিশ শতকীয় আভিজাত্যের সামন্ততান্ত্রিক চিন্তন থেকে বার হতে পারেনি৷ সে মনে করে, উমমম করে গোঁফ পাকিয়ে, বা গম্ভীর হয়ে হাত চিবুকে ঠেকিয়ে ঈশান কোনে তাকিয়ে থাকা শিল্পীরাই একমাত্র শিল্পী, বাকিরা খেলো, ছ্যা-ছ্যা করে তাদের উঠোনের বাইরে বার দেওয়াই রীতি৷ পঞ্জাবে চমকিলার বিরুদ্ধ মতের গোড়ায় হয়ত ধর্মের উগ্রতা ছিল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও এই গল্পটা মিলে যায় সাংস্কৃতিক মৌলবাদে৷ সেই কারণেই খটকা লাগে, মনে হয়, ওই ‘দাদা’ বা ‘অমুক বাবুর’ কথা! আর ইদানিংকালের পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের ফাঁকা আস্তরণে আঘাত লাগে৷

তা হলে কী ফ্যাতাড়ু এবার ‘হায়, তাতঃ’ বলে বাক্য আরম্ভ না করলে নবারুণকেও ক্যানসেল করবেন আপনারা? দেখুন তো, একবার ভেবে! আপনাদের পলিটিক্যাল কারেক্টনেস কী বলে?