Durga Puja 2024: নাচ-গান থেকে ইংরেজি খানা-পিনা…কেমন ছিল নব্যবাবু বা ‘জেন্টু’দের দুর্গোৎসব?

কলকাতা:  পলাশীর যুদ্ধের পর পরই কলকেতায় সাহেবদের নিজ ভবনে নেমন্তন্ন করে ফূর্তির ফোয়াড়া ছোটানো শুরু করল রাজরাজরা, জমিদারের দল। সাহেবসুবোদেরও এইসব নব্যবাবু বা ‘জেন্টু’দের আমন্ত্রণে মুখে লাল গড়াত! এক কথায়, মায়ের দয়ায় মোচ্ছব!

শোনা যায়, দিল্লির আকবর বাদশাহের সময় বাংলার রাজশাহি জেলার তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বাংলায় প্রথম দুর্গা পুজোর প্রচলন করেছিলেন। এই পুজোকে জনসাধারণের মধ্য জনপ্রিয় করেছিলেন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ১৭২৮ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আসার পর প্রথম দুর্গা পুজো করেন। হুতোম তাঁর ‘দুর্গোৎসব’ নকশাতে লিখেছেন– ’’ বোধ হয়, রাজা কৃষ্ণচন্দরের আমল হতেই বাঙ্গালায় দুর্গোৎসবের প্রাদুর্ভাব বাড়ে, পূর্ব্বে রাজারাজড়া ও বনেদি মানুষদের বাড়িতেই কেবল দুর্গোৎসব হত।’’

গ্রাম-কলকাতায় দুর্গোৎসব হত। ১৯৬৮ সালে সুতানটি-কলকাতা- গোবিন্দপুর– এই তিনটে গ্রাম ইংরেজ কোম্পানির হাতে আসার পর থেকে পলাশীর যুদ্ধের সময় পর্যন্ত দেশীয় কোনও দুর্গোৎসবে সাহেবরা সোৎসাহে যোগদান করেছেন, এমনটা শোনা যায়নি। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের বছর থেকে নবকৃষ্ণ দেববাহাদুরের হাত ধরেই শুরু হল দুর্গোৎসবে সাহেবি-আনন্দ।

হরিসাধন মুখোপাধ্যায় ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’- এ লিখেছিলেন, ’’ পলাশী যুদ্ধের পর মীরজাফরের সিংহাসনারোহণের দিন নবকৃষ্ণ দরবারে উপস্থিত হইয়াছিলেন। নবাবের ধনাগার পরীক্ষার সময়েও তিনি ক্লাইভের সঙ্গে ছিলেন। কথিত আছে, নবাবের প্রকাশ্য ধনাগারের দুই কোটি টাকা বিভাগ করিয়া লইবার পর মীরজাফর, আমীর রেজা খাঁ, ইংরাজদিগের দেওয়ান রামচাঁদ রায় (আন্দুল রাজবংশের পূর্বপুরুষ) ও মুন্সী নবকৃষ্ণ এই গুপ্ত ধনাগার হইতে আট কোটি টাকার স্বর্ণ, রৌপ্য ও রত্নাদি গ্রহণ করেন। কিন্তু নবকৃষ্ণের জীবন চরিত লেখক বলেন, একথার মূলে কোন বিশ্বাসযোগ্য সমর্থক প্রমান নাই। যে কোন কারণেই হউক নবকৃষ্ণ এই সময়ে প্রচুর বিত্তশালী হইয়াছিলেন। পলাশী যুদ্ধের পর দুর্গোৎসবের অল্প দিন মাত্রই অবশিষ্ট ছিল, কিন্তু নবকৃষ্ণ সেই অল্প দিনের মধ্যেই পূজার দালান নির্মাণ করাইয়া মহাসমারোহে শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গোৎসব করিয়াছিলেন। কলিকাতার বহু পদস্থ ইংরাআজ কর্মচারী এই পুজায় উপস্থিত ছিলেন।’’

মহারাজ নবকৃষ্ণদেব তাঁর কোনও এক বন্ধুকে দুর্গা পুজোয় নিমন্ত্রণ করেছিলেন যে ব্যক্তিগত চিঠি লিখে, সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ’’ এবার পুজোর সময় লর্ড ক্লাইভ আমার বাটিতে অনুগ্রহপূর্বক প্রতিমা দর্শন করিতে আসিবেন। তাঁহার সহিত কোম্পানির বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকিবেন। তোমার আসা চাই।”

প্রাচীন দুর্গোৎসবের যে ঐতিহ্য ছিল, সেই বুনিয়াদ ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার ভিত স্থাপিত হল শোভাবাজারে। কলকাতায় নতুন জেন্টুদের দুর্গোৎসব পর্বের সূচনা হল এই সময় থেকে। ‘কলকাতা কালচার’-এর ‘এই সময়ের কথা’-য় বিনয় ঘোষ লিখেছেন, ’’ ব্রিটিশ আমলের নতুন জমিদার, তালুকদার ও পত্তনিদাররা এবং হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বিত্তবান ‘জেন্টু’রা কলকাতা শহরে বা আশেপাশে গ্রামাঞ্চলে নতুন যে জোয়ার আনার চেষ্টা করেছিলেন, সেটা আসলে স্বাভাবিক জোয়ার নয়, অস্বাভাবিক একটা বন্যা, একটা তরঙ্গচ্ছাস–পাঁক ও আবর্জনাই ছিল তার মধ্যে বেশি। উচ্ছ্বাসের বুদবুদ মিলিয়ে যাবার পর সেই আবর্জনার তলানি জমতে বেশি সময় লাগেনি। ক্লাইভ হেস্টিংস হলওয়েল সাহেবের যু্গে, শোভাবাজারের রাজা মুন্সী নবকৃষ্ণ, আন্দুলের রাজা দেওয়ান রামচাঁদ রায়, ভূকৈলাসের রাজা দেওয়ান গোকুলচন্দ্র ঘোষাল, দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ প্রভৃতির আমলেই দেখা যায় বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ জাতীয় উৎসব ‘গ্র্যান্ড ফীস্ট অফ দি জেন্টুস’-এ পরিণত হয়েছে।’’

১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকায় একটি খবর বেরিয়েছিল–’’ মহারাজ নবকৃষ্ণ বাহাদুরের দুই বাটিতে নবমীর রাত্রে শ্রীশ্রীযুত গভরনর জেনেরল লর্ড বেন্টিঙ্ক বাহাদুর ও প্রধান সেনাপতি শ্রীশ্রীযুত লর্ড কম্বরীর ও প্রধান ২ (প্রধান) সাহেব লোক আগমন করিয়াছিলেন। তাঁরা রাত ‘দুই দণ্ড পর্য্যন্ত নানা আমোদ ও নৃত্যগীতাদি দর্শন ও শ্রবণ করত অবস্থিতি করিয়া প্রীত হইয়া গমন করিলেন।’’

সাহেবদের মনোরঞ্জনের উপাদানে কোনও খামতি থাকত না। নাচ-গান থেকে ইংরেজি খানা-পিনা… সবেরই আয়োজন থাকত।

ফ্যানি পার্কস ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার দুর্গোৎসব দেখে দেবীর বর্ণনা দিয়েছিলন– ’’ সেদিন দুর্গাপূজা দেখতে গিয়াছিলাম একজন ধনিক বাঙালীবাবুর বাড়ি। ‘দুর্গা’ নামে হিন্দুদের যে দেবী আছেন তাঁরই ‘অনারে’ এই উৎসব হয়। বাবুর চারমহলা বাড়ি, মধ্যিখানে বিরাট উঠোন। সেই উঠোনের এক পাশে উঁচু মঞ্চের উপর দেবী দুর্গার সিংহাসন পাতা। সিংহাসনের উপর দুর্গার মাটির প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত। মঞ্চের দু’ধারে সিঁড়িতে ব্রাহ্মণেরা উপনিষ্ট, পূজার অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। প্রতিমার ডানহাত দিয়ে তিনি এক ভীষণাকৃতি অসুরকে বর্শাবিদ্ধ করেছেন, বামহাতে একটি বিষাক্ত সাপের লেজসহ অসুরের ঝুঁটি ধরেছেন, সাপটি অসুরের বক্ষস্থল দংশন করছে। বাকি আটটি হাত ডাইনে-বামে প্রসারিত, প্রত্যেক হাতে একটি করে মরণাস্ত্র। তাঁর দক্ষিণ হাঁটুর কাছে একটি সিংহ এবং বাম হাঁটুর কাছে অসুর। সিংহ দেবীকে বাহন করেছে মনে হয়।’’

পুজোয় সাহেব-সুবোদের ভোজ নিয়েও লেখেন ফ্যানি পার্কস– ’’ পূজামণ্ডপের পাশের একটি বড় ঘরে নানারকমের উপাদেয় সব খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে সাজানো ছিল। সবই ইয়োরপীয় অতিথিদের জন্য বিদেশী পরিবেশক ‘মেসার্স গান্টার অ্যান্ড হুপার’ সরবরাহ করেছিলেন। খাদ্যের সঙ্গে বরফ ও ফরাসী মদ্যও ছিল প্রচুর।’’

এর পরের বর্ণনা নাচের– ’’ মণ্ডপের অন্যদিকে বড় একটি হলঘরে সুন্দরী সব পশ্চিমা বাইজীদের নাচগান হচ্ছিল এবং ইয়োরোপীয় ও এদেশি ভদ্রলোকেরা সোফায় হেলান দিয়ে, চেয়ারে বসে সুরা-সহযোগে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। বাইরেও বহু সাধারণ লোকের ভিড় হয়েছিল বাইজীদের গান শোনার জন্য। গানের হিন্দুস্থানী সুরমণ্ডপে সমাগত লোকজনদের মাতিয়ে তুলেছিল আনন্দে।’’

পুজোর কথায় তিনি লেখেন– ‘‘আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি চলতে থাকে। পাঁচদিন পরে ষষ্ঠির দিন দেবী জেগে ওঠেন এবং সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর দিনে মহাসমারোহে তাঁর পূজা হয়। নবমীর দিন বলিদান হয় এবং এককোপে মুণ্ডচ্ছেদ করতে না পারলে বলি নাকি সার্থক হয় না।’’ সবশেষে তিনি লেখেন– ’’ আর ধনিক বাঙালীবাবুরা পূজার সময় যে পরিমাণ অর্থব্যয় করেন তার হিসেব নেই।’’ (অনুবাদ)