২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর তাঁর শারীরিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। রক্তচাপের ক্রমঅবনতির কারণে তাঁকে মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ছিলেন দেশের প্রথম সারির সুদক্ষ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু কালের আহ্বানে সাড়া দিতেই হয়। বুধবার ৯ অক্টোবর মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতীয় শিল্পজগতের এই সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব।
জীবন শুধুই সাফল্যে পূর্ণ, তা কখনই হয় না। অনেকেই ভাববেন যে রুপোর চামচ মুখে নিয়েই জন্মেছিলেন তিনি, যাত্রাপথও অতএব ছিল মসৃণ। বাস্তব কিন্তু তেমন নয়। ঠিক কেমন ছিল তাহলে দেশের সদ্য প্রয়াত প্রবাদপ্রতিম উদ্যোগপতি রতন টাটার জীবন? এই মহাজীবনের মূল্যায়ণ হবে বস্তুত তাঁর ছয় দশকেরও বেশি সময় জুড়ে থাকা কর্মজীবনের নিরিখে, একের পর এক সাফল্যের ধাপ কীভাবে পেরিয়ে এসেছিলেন তিনি, জেনে নেওয়া যাক সে কথাই। সেই কথা রূপকথাকেও যেন বা হার মানায়!
প্রারম্ভিক জীবন- ডিসেম্বর ২৮, ১৯৩৭-এ রতন টাটা ভারতের অন্যতম ধনী এবং সবচেয়ে সম্মানিত ব্যবসায়ী পরিবারে মুম্বইতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতামাতা, নেভাল এবং সোনু টাটার বিচ্ছেদের পরে, রতন তাঁর দাদি, লেডি নবজবাঈ টাটার কাছে বড় হয়ে ওঠেন।কালক্রমে টাটা গ্রুপের বিস্তার- এ তো স্বতসিদ্ধ! কিন্তু এক শিল্প প্রতিষ্ঠানে মানবিকতার সঞ্চারও যে করা যায়, তার একমাত্র দৃষ্টান্ত বোধহয় তিনিই। ছয় দশকেরও বেশি সময় জুড়ে বর্ণময় কর্মজীবনে সারা বিশ্বের কাছে প্রচেষ্টা, সাফল্য এবং সহানুভূতির নাম হয়ে থাকবেন রতন টাটা।
আরও পড়ুন: পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মুম্বইয়ের ওরলিতে শিল্পপতি রতন টাটার শেষকৃত্য
শিক্ষা- ১৯৬২ সালে তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিটেকচার এবং স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হন। ১৯৭৫ সালে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের একটি কোর্স সম্পন্ন করেন। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর অ্যাকাডেমিক পটভূমি টাটা গ্রুপের জন্য তাঁর ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সাহায্য করেছে।
টাটা গ্রুপে যোগদান- ১৯৬২ সালে রতন টাটা টাটা গ্রুপে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, টাটা স্টিলের দোকান থেকে শুরু হয়েছিল এই যাত্রাপথ, যেখানে তিনি ব্লু-কলার ওয়ার্কারদের সঙ্গে কাজ করতেন।
চেয়ারম্যান পদ লাভ- ১৯৯১ সালে টাটা সন্স এবং টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসাবে জেআরডি টাটার জায়গায় তিনি দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে সংস্থা বিশ্ববাজারে বিস্তৃত হয় এবং বিভিন্ন শিল্পোদ্যোগে বৈচিত্র্য লাভ করে।
আরও পড়ুন: অমূল্য ‘রতন’ হারাল ভারত, টাটা গ্রুপের প্রবাদপুরুষের জীবন এক অত্যুজ্জ্বল গাথা
আন্তর্জাতিক ব্যবসা অধিগ্রহণ- টাটার সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল টেটলি (ইউকে), কোরাস (ইউকে) এবং জাগুয়ার ল্যান্ড রোভারের (ইউকে) মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলিকে অধিগ্রহণ করা, ভারতীয় ব্যবসা এভাবেই নিজের জায়গা করে নিল বিশ্ব মানচিত্রে।
টেলিকম দুনিয়ায় প্রবেশ- ১৯৯৬ সালে, তিনি টাটা টেলিসার্ভিস লঞ্চ করে টেলিকম সেক্টরে একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যা বাণিজ্য দিগন্তে সংস্থার একচ্ছত্র অধিকার লাভের সম্ভাবনাকে প্রসারিত করেছিল।
দেশীয় গাড়ি তৈরি- ১৯৯৮ সালে টাটা ইন্ডিকা লঞ্চ হল, যা টাটা মোটরসের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। এই প্রথম ভারতে যাত্রীবাহী গাড়ি তৈরি হল।
টাটা কমিউনিকেশনস- একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলতেই হয়, টাটা সন্স ২০০২ সালে VSNL অধিগ্রহণ করে, যা টাটা কমিউনিকেশনসের পথ প্রশস্ত করে।
টাটা ন্যানো লঞ্চ- ২০০৮ সালে, রতন টাটা জনসাধারণের একটি গাড়ি থাকার স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন। টাটা ন্যানো এসেছিল বাজারে, যার দাম মাত্র ১ লক্ষ টাকা, তা ছিল একাধারে একটি প্রযুক্তিগত বিস্ময় এবং ভারতীয় পরিবারের জন্য গাড়িগুলিকে সাশ্রয়ী করার একটি প্রচেষ্টা৷ টাটা ন্যানো ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক বাজারেও যায়, বিশ্ব মঞ্চে ভারতীয় উদ্ভাবন প্রদর্শন করে সগৌরবে।
স্টারবাকসের সঙ্গে অংশীদারিত – ২০১২ সালে টাটা গ্লোবাল বেভারেজ স্টারবাকসের সঙ্গে যোগ দেয়, যা কফি শিল্পে একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগকে চিহ্নিত করে।
পরোপকার- রতন টাটা শুধুমাত্র তাঁর ব্যবসায়িক দক্ষতার জন্যই নয়, তাঁর পরোপকারের জন্যও পরিচিত। টাটা গ্রুপের লাভের প্রায় ৬৫% দাতব্য ট্রাস্টে যায়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং গ্রামীণ উন্নয়নের উপরে তা কাজ করে।
অবসর- সেভাবে নেননি বললেই চলে! রতন টাটা ২০১২ সালে টাটা সন্সের চেয়ারম্যান হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন, কিন্তু তাঁর জনহিতকর কাজে সক্রিয় থাকেন এবং বিভিন্ন পরামর্শে সংস্থাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেন।
সম্মান ও পুরস্কার- শিল্প ও সমাজে তাঁর অবদানের জন্য, রতন টাটা যথাক্রমে ভারতের তৃতীয় এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণ (২০০০) এবং পদ্মবিভূষণ (২০০৮) সহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।