হাসপাতালের নাম আর জি কর কেন, জানেন আসল কারণ ?

RG Kar Medical College: শিরোনামে আরজি কর, এই হাসপাতালের পুরো নাম কী? প্রতিষ্ঠাতা কে জানেন? চমকে যাবেন

হাওড়া: সংবাদ শিরোনামে কলকাতার আরজি কর হাসপাতাল। জানেন আরজি কর হাসপাতালের তৈরির ইতিহাস? হাওড়ায় পৈতৃক ভিটের ফটকে জ্বল জ্বল করছে ডাক্তার আরজি কর-এর নাম।

সেই সময়ের বিলেত ফেরত একজন বিখ্যাত ডাক্তার। বিলেত ফেরত হলেও এ ডাক্তারের মধ্যে বিন্দুমাত্র নেই অহংকার বোধ। এ ডাক্তারের অধিকাংশ রোগীই দীন-দরিদ্র। গরিব মানুষের কাছে এ ডাক্তার যেন স্বয়ং ভগবানই বটে। যদিও তাঁর সঙ্গ দিয়েছেন সে সময়ের বেশ কিছু অন্য ডাক্তারও। এমনটাই জানালেন,  কর বাড়ির অন্যতম সদস্য পার্থ কর।

বর্তমানে কলকাতার আরজি কর হাসপাতাল সংবাদ শিরোনামে। ডাক্তারি ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা ঘটেছে সেখানে। যে কারণে সারা বাংলা-তথা দেশ তোলপাড়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ পথে নেমে এর সুবিচারের দাবি জানাচ্ছেন। ঐতিহাসিক এই হাসপাতালের নামের সঙ্গে জুড়ে ভয়ানক কাণ্ড। কিন্তু এই হাসপাতাল সৃষ্টি এবং স্রষ্টার ইতিহাস জানেন কি?

সম্পূর্ণ কাহিনি শুনলে অবাক হবেন। ১৯০০ সালের কাছাকছি অবিভক্ত বাংলার ব্রিটিশ শাসনাধীন। সে সময় দেশে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ তো ছিলই না, সারা দেশে হাতে গোনা কয়েকজন ডাক্তার। স্কটল্যান্ড থেকে ডাক্তারি পাশ করে এই বাংলা তথা নিজের বাড়ি হাওড়ায় ফিরে এসেছিলেন। জানা যায়, বাবা দুর্গাদাস কর ছিলেন অভিভক্ত বাংলায় মেডিক্যাল অফিসার। তিনি ঢাকা মিডফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বেলগাছিয়া থেকে দমদম বাড়ি বাড়ি সাইকেল চালিয়ে ঘুরছেন ডাক্তার।

আরও পড়ুন: নেমপ্লেট আছে, মানুষটাই আর নেই! খাঁখাঁ করছে সোদপুরের চেম্বার, হাওয়ায় শুধু ভাসছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’!

মাথায় একটা টুপি আর সাইকেলে ঝোলানো ক্যামবিসের ব্যাগ। রোগী দেখাই শেষ নয়, নানা ভাবে সহযোগিতা এমনকী ওষুধ কেনার পয়সাও দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু। বিলেত ফেরত ডাক্তারের দরিদ্র রোগীদের জন্য এত কদর, ভাবতে অবাক লাগার মতোই বটে। এমনও শোনা যায়, ১৮৯৯ সালে প্লেগ তখন কলকাতায় মহামারীর আকার নিয়েছে। সেই সময়ে উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে ঘুরে রোগীদের সেবা করে চলেছেন এক আইরিশ মহিলা।

জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিক পদে নিয়োজিত এক ডাক্তারও রোগীদের বাঁচাতে উত্তর কলকাতা চষে ফেলছেন। রোগ থেকে বাঁচার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিছুদিন পরে সেই বিদেশিনী ও চিকিৎসকের আলাপ হল। প্লেগের সংক্রমণ রুখতে ও মৃত্যুর হার কমাতে দু’জনে একজোট হয়ে কাজ করলেন তাঁরা। সেই আইরিশ মহিলা হলেন ভগিনী নিবেদিতা। আর সেই ডাক্তার কে জানেন? তিনি হলেন ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর।

আরও পড়ুন: পড়ুয়াদের অ্যাকাউন্টে ঢুকবে ১,২৫,০০০ টাকা, যশস্বী স্কলারশিপ জানেন তো? কীভাবে আবেদন জানুন

কলকাতার সেরা হাসপাতালগুলির মধ্যে একটি হল আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। বিখ্যাত এই হাসপাতালের স্রষ্টা হলেন হাওড়া বেতরের ডা রাধাগোবিন্দ কর। সারা বাংলার মানুষের চিকিৎসার সুবিধার্থে একজন ডাক্তার সারাটা জীবন লড়াই করেছেন। হাওড়া জেলার রামরাজাতলা স্টেশনে থেকে সামান্য দূরত্বে বেতড়ের বিখ্যাত কর বাড়ি। ডা রাধাগোবিন্দ কর এর জন্মভিটে। ১৮৫০ সালের ২৩ অগাস্ট তাঁর জন্ম। জানা যায়, রাধাগোবিন্দ কর হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করার পর চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাঠ গ্রহণের জন্য ১৮৮০ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন।

১৮৮৩ সালে ডাক্তারি পড়তে কলকাতা ছেড়ে স্কটল্যান্ডে পাড়ি দেন রাধাগোবিন্দ। ১৮৮৭ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিদ্যার শ্রেষ্ঠ অলংকারে ভূষিত হলেন MRCP হয়ে। বিদেশে ডাক্তারি করার সুযোগ থাকলেও তিনি ফিরে এলেন এই বাংলায়। একজন বিলেত ফেরত ডাক্তার হয়ে এ বাংলার অসহায় গরীব মানুষদের পাশে দাঁড়ালেন। সেই সময় চিকিৎসাবিদ্যা পড়াশোনা হত ইউরোপীয় চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থায়। বাঙালি সন্তানরা ডাক্তারি পড়তে সমস্যায় পড়তেন। চিকিৎসা স্বাস্থ্যের একাধিক বই তিনি লেখেন। ১৮৭১ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম বই ‘ভিষগবন্ধু’।

এর পরবর্তীতে ভাবেন। এদেশের মানুষের জন্যে একটি হাসপাতাল তৈরি করবেন। হাসপাতালের অর্থ সংগ্রহ করতে সে সময় এই বিলেত ফেরত ডাক্তার ভিক্ষা পর্যন্ত করেছেন। তখনকার দিনে কলকাতার বড়লোকদের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করেছেন। বড়লোক বাড়িতে কোনও আনন্দ অনুষ্ঠান হলে সেই বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন ভিক্ষা চাইতেন ‘অনুরোধ, কিছু টাকা পয়সা যদি সাহায্য করেন, খুব উপকার হয়, সবার জন্য একটা হাসপাতাল তৈরি করতে পারি’।

চিকিৎসক হিসেবে অর্জিত অর্থের সমস্তটাই দান করে গিয়েছেন মেডিক্যাল স্কুল ও হাসপাতাল স্থাপনে। বেলগাছিয়ায় ১২ বিঘে জমি কিনে নেন ডাক্তার কর। সেখানেই গড়ে ওঠে হাসপাতাল। আত্মপ্রকাশ করে বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ। কিন্তু সেই নাম বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯১৬ সালের ৫ জুলাই মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতল ভবনের উদ্বোধন করেন লর্ড কারমাইকেল। তাঁর সম্মানে বদলে যায় নাম। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ হিসেবেই পরিচিত ছিল এই চিকিৎসা শিক্ষাকেন্দ্রটি। ১৯৪৮ সালে তীব্র আর্থিক সঙ্কটের সময় ফের নাম বদলের দাবি ওঠে।

পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় অবশ্য তা হতে দেননি। তাঁর উদ্যোগেই ডা রাধাগোবিন্দ করের নামেই কলেজের নাম রাখা হয় ‘আর জি কর’। যদিও বর্তমান সময়ও দু’জন ডাক্তার রয়েছেন এই কর বাড়িতে। সেকাল থেকে একাল সমাজ ও সাধারণ মানুষের জন্য হাওড়ার কর পরিবারের নানা কর্মকাণ্ড জারি রয়েছে। আরজি কর হাসপাতালের ঘটনা প্রসঙ্গে পরিবার সদস্য পার্থ কর জানান, ‘আমরা কোন প্রশ্নের উত্তর চাইছি না, আমরা চাইছি এই বর্তমান সমস্যার দ্রুত সমাধান। যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এই হাসপাতাল বাংলার মানুষের সেবায় থাকুক। পরবর্তী সময়ে কোনও ভাবে এমন সমস্যার সম্মুখীন না হয় হাসপাতাল।’

(রাকেশ মাইতি)