Arun Anand
ভারতের প্রতিবেশী দেশ নেপাল। আয়তন হোক বা অর্থনীতি, সবদিক থেকেই নেপালের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে চিনের আগ্রাসী নীতি থেকে নেপালও বাদ পড়েনি। তিব্বতকে নেপাল থেকে পৃথক করার জন্য হিমালয়ের মতো দুর্গম অঞ্চলেও কাঁটাতার ও কংক্রিটের প্রাচীর দিয়ে দুই অঞ্চলকে আলাদা করেছে চিন। কোনও অনুপ্রবেশকারী দূরের কথা, নজরদারি ক্যামেরা আর বন্দুকধারী চিনা সীমান্তরক্ষীদের কড়া পাহারায় কাকপক্ষীও গলতে পারে না।
তিব্বতের উচ্চ মালভূমি অঞ্চলে, পাহাড়ের গায়ে চিন ৬০০ ফুট লম্বা বার্তা খোদাই করেছে: “চিনের কমিউনিস্ট পার্টি দীর্ঘজীবী হোক”– এত বিস্তৃত এবং বড় এই খোদাই করা বার্তা, যা মহাকাশ থেকে স্যাটেলাইটেরও নজরে এসেছে।
আরও পড়ুন- সাধের গোলাপ গাছে ফুলই আসে না? সার ছাড়ুন, গোড়ায় দিন ‘এই’ জিনিস, ফুল উপচে পড়বে দু’দিনে!
তবে নেপালের হুমলা জেলায় বসবাসরত বাসিন্দাদের যা অভিযোগ তা এই দেশের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। তাঁদের দাবি অনুযায়ী, এই দূরবর্তী সীমান্ত দিয়ে চিন-নেপাল ভূখণ্ডে ক্রমাগত অনুপ্রবেশ করে চলেছে। এছাড়াও তাদের অন্যতম অভিযোগ, চিনের নিরাপত্তাবাহিনী তিব্বতি নেপালিদের দলাই লামার ছবিও প্রদর্শনে বাধা দিচ্ছে। চিনের সীমান্তে লাগানো বেড়া এবং আঁটোসাঁটো প্রতিরক্ষা কারণে এই অঞ্চলে বসবাসরত লোকজন দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একসময়ে যাঁরা চিন সরকারের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নেপালে সদলবদলে পালিয়ে আসতেন, সেই তিব্বতিদেরও এখন আর দেখা যায় না।
আরও পড়ুন- নাক ও ঠোঁটের মাঝের ‘অংশ’কে কী বলে? কেউ বলতে পারেনি…! আপনি কি পারবেন?
নেপালের নেতারা তবুও চিনের এই পদক্ষেপগুলি নিয়ে কোনও কথা বলতে রাজি নন। চিনের সঙ্গে মতাদর্শগত মিল থাকায় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে নেপালের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সরকার ২০২১ সালে প্রকাশিত এক তথ্যনিষ্ঠ প্রতিবেদন উপেক্ষা করে, যেখানে হুমলা জেলার সীমান্তে চিনের একাধিকবার অনুপ্রবেশ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল।
নেপালের ওই অঞ্চলের প্রাক্তন প্রাদেশিক মন্ত্রী জীবন বাহাদুর শাহী যেমন জানিয়েছেন, “চিনের এটাই নতুন মহাপ্রাচীর, কিন্তু তারা আমাদের তা দেখাতে চায় না।”
নেপালের হুমলা জেলার সীমানা বরাবর শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে কাঁটাতারের বেড়া গড়ে তুলে চিন মাইলের পর মাইল সীমান্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দুর্গ গড়ে তুলছে যা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে চিনের যেমন শক্তি বাড়াচ্ছে, সঙ্গে বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। এর পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের ভূখণ্ডে প্রভাব রাখারও মানসিকতা বজায় থাকছে।
সীমান্তের এই শক্তিশালী রক্ষণব্যবস্থা কোভিডের সময় যেন আরও দ্রুত গড়ে তোলা হয়, এবং চিনের সীমান্তে থাকা অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিবেশী দেশগুলির উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিল।
চিন মোট ১৪টি দেশের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে নেয়। বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ দেশ হয়ে ওঠার জন্য স্থল ও সমুদ্র দুই সীমান্তের দিক থেকেই চিন বেশ শান্ত অবস্থায় ছিল। কিন্তু শি জিনপিংয়ের আমলে বেজিং তার ভৌগোলিক সীমানা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যা প্রায়ই সংঘর্ষ এবং সংঘাত ডেকে আনছে। নেপালের মতো ছোট দেশগুলো, যারা চিনের উপর অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল, তারা এই সমস্যাকে উপেক্ষা করে চলেছে। চিনের অর্থনৈতিক সমর্থন হারানোর ভয়ে তারা সীমান্ত বিরোধের বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আনতে চায় না।
ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের চায়না পাওয়ার প্রজেক্টের ফেলো ব্রায়ান হার্টের মতে, শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চিন বিতর্কিত অঞ্চলে তার সীমান্ত দাবির প্রতিষ্ঠায় দ্বিগুণ প্রচেষ্টা করেছে।
চিনের সীমান্ত বরাবর নির্মাণ কাজ, আঞ্চলিক বিরোধ এবং বিতর্কিত অঞ্চলে প্রবেশের মতন ঘটনাগুলিকে সামান্য মনে করলে কিন্তু প্রচন্ড ভুল হবে। এই ছোট ছোট ঘটনাগুলিরই কিন্তু সব মিলিয়ে প্রভাব অসম্ভব জোরালো।
চিনের পূর্ব সমুদ্র উপকূল আন্তর্জাতিক দিক থেকে ফিলিপিন্সের জলসীমা হিসেবে স্বীকৃত। সেখানে ইতিমধ্যেই চিন একটি প্রবালপ্রাচীরকে সামরিক ঘাঁটিতে বদলে নিয়েছে। অপরদিকে পশ্চিম সীমান্তে, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলির বিতর্কিত পাহাড়ি অঞ্চলগুলিতেও প্রবেশ করেছে।
২০২০ সালে, ভারত এবং চীনের মধ্যে পার্বত্য এলাকায় সংঘাত বাঁধে যাতে দুই দেশের প্রায় ২৪ জন সৈন্য প্রাণ হারায়। ২০২২ সালে আবারও সীমান্ত সংঘর্ষ লাগে, যাতে আরও সৈন্য আহত হয়।
নেপাল ছোট একটি দেশ হিসাবে এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল। তারা সীমান্তের বিভিন্ন অসুবিধা উপেক্ষা করে চিনের অর্থনৈতিক সহায়তা ধরে রাখতে চায়, যতই চিন তাদের সীমান্ত নিয়ে বিরোধে যাক না কেন।
নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রী, আরজু রানা দেউবা, সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে তিনি সীমান্তে কোনও সমস্যা নিয়ে কোনও অভিযোগ পাননি এবং তাঁর মাথাব্যথা নেপালের দক্ষিণের সীমান্ত নিয়ে যা ভারতের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে নেপাল, কারণ সেখানেই বেশি নেপালি মানুষ বসবাস করে। আরজু রানা দেউবা জানিয়েছেন উত্তর সীমান্তের দিকে খুব বেশি মনোযোগ তাদের তরফ থেকে তেমন ভাবে দেওয়া হয়নি।
হুমলা জেলার রাজধানী সিমিকোট থেকে সীমান্ত গ্রাম হিলসা পর্যন্ত প্রায় ৩০ মাইল পথ, কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে গাড়িতে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। হুমলা নেপালের জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্কের সঙ্গেও সংযুক্ত নয়।
হুমলা এতটা উচ্চতায় অবস্থিত যেখানে উচ্চতাজনিত কারণে অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুও পর্যন্ত হতে পারে। এমন অবস্থায় তিন বছর আগে নেপালি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সরকারি জরিপকারী এবং পুলিশের একটি তথ্য অনুসন্ধানী দল সেখানে গিয়ে এই অঞ্চলের সীমান্ত পরিস্থিতি পরীক্ষা করে অবশেষে তারা একটি প্রতিবেদন তৈরি করে নেপালের মন্ত্রিসভায় জমা দেয়। প্রতিবেদনে সীমান্তে চিনের বেশ কিছু ছোট অনুপ্রবেশের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও, চিনের বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে কথা বলা হয়েছে।
হিলসা এবং চিনের নিয়ন্ত্রিত তিব্বতের মধ্যে থাকা সীমান্ত বেড়াটি শুধু দুটি দেশ নয়, বরং দুটি দেশের উন্নয়নকেও আলাদা করেছে। চিনের দিকে আধুনিক বাড়ি, সাঁজোয়া গাড়ি এবং আলো দেওয়া রাস্তা রয়েছে। অন্যদিকে, নেপালের না আছে পাকা রাস্তা না আছে বিদ্যুৎ সরবরাহ।
চিনের পুলিশ এবং সীমান্তরক্ষীরা নেপালের মধ্যে প্রায়ই ঢুকে পড়ে। তিব্বতি নেপালিদের ধর্মীয় কার্যক্রমে তাদের হস্তক্ষেপ চোখে পড়ার মতন।
চিন বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্র, তাই তারা যা খুশি করতে পারে, জানিয়েছেন পেমা ওয়াংমু লামা। তাঁর মতে, “যদি একদিন হিলসা চিনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তাহলে হয়তো কেউ জানতেই পারবে না এখানে একসময় কী ঘটেছিল।”
(বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট অরুণ আনন্দ, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। তার লেখা প্রবন্ধ ও বই পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। আপনি তাকে তার X (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডল @ArunAnandLive -এ অনুসরণ করতে পারেন।)