কী হবে বাংলাদেশে?

Bangladesh: শেখ হাসিনা সরকারের পতন, বাংলাদেশের কি আদতে ভাল হল? নাকি আসছে প্রবল খারাপ দিন

প্রায় একমাস বাংলাদেশ জুড়ে প্রতিবাদ গণঅভ্যুথান চলার পর, দেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, অগাস্ট মাসে জানান, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপসারণের কথা। তারপরেই হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসেন। বিক্ষোভের ফলে হাসিনা সরকারের অপসারণের কথা বাংলাদেশ সেনা সাবধানতার সঙ্গে এড়িয়ে যায়। দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনী গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে।

বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি মুজিবর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ সামলান। তারপর দ্বিতীয় বারে ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তিনি প্রধামন্ত্রিত্বের দায়ভার আবার পান। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে হাইব্রিড মিলিটারি-টেকনোক্র্যাটিক অনুশাসন পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু হয়েছিল। যা আবার দেশের পক্ষে আবার জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সবথেকে লম্বা সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। হাসিনার সময়েই দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি আরও ভাল জায়গায় পৌঁছায়। হাসিনা চরমপন্থী ইসলামিদের কড়া হাতে দমনও করেন।

শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সরকার গঠন করে। তবে নির্বাচনেই গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়, একপাক্ষিক ফলাফলের কারণে। বিরোধীদের মতে হাসিনা সরকারের চতুর্থবার পদে আসীন হয়েছেন সম্পূর্ণভাবে ভোট রিগিং এবং বিরোধী দলকে দিনের পর দিন দমনপীড়নের মধ্যে দিয়ে। হাসিনার সমর্থকরা বিরোধীদের উপর নেওয়া কঠিন ব্যবস্থা নিয়ে বহু যুক্তি দেখিয়েছে।

হাসিনার নেওয়া নীতিগুলি যেমন অর্থনৈতিক ভাবে দেশকে মজবুত করেছে, তেমনই জিহাদী এবং মাদক ব্যবসায়ীদের বাধার সম্মুখীন করেছে। তবে তাদের যুক্তিগুলি বিচারবহিৰ্ভূত হত্যা, অপহরণ, এবং গ্রেফতারের মতো অহেতুককাজের কাছে ধোপে টেকেনি। বহুদিন ধরেই মানুষের ক্ষোভ সরকারের উপর জমেছিল, তার প্রতিফলন দেখা দিয়েছে হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবির প্রতিবাদে।

আরও পড়ুন: ঘটনার দিন হোটেলে কেন ছিলেন, সঙ্গে কে ছিল? আরজি কর কাণ্ডে এবার বড় হোটেল-রহস্য

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন সেইসব মানুষদের পরিবারের জন্য হাসিনা সরকারের সহানুভূতি বরাবরের। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধে যারা পাকিস্তানের হয়ে লড়েছিল তাদের উপর হাসিনা বেশ কিছুটা কড়া ভাবেই নজরদারি রাখতেন। কিন্তু যারা বর্তমান প্রজন্ম তারা আগের মানুষদের মতো বিশ্বাস ধরে রাখেনি। তাদের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে স্বভাবতই।

অসন্তোষ শুরু হওয়ার মূল কারণ:
২০২৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক টানাপোড়েন শুরু হয়। এতগুলো বছরে মানুষের মনে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল তা এতদিন পর যেন তার বহির্প্রকাশ ঘটে। আন্দোলনের পর শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পড়ার ঘটনা অন্যতম কারণ। করোনা মহামারীর সময় বাংলাদেশের কাপড় শিল্প ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যার ফলে দেশের অর্থচালিকা শক্তি আমদানি ও রফতানি দুই দিক দিক দিয়েই ক্ষতির সম্মুখীন হয়। রফতানি কমে যাওয়ায়, দেশে বিদেশী মুদ্রা কম আসতে শুরু করে এবং স্বাভাবিকভাবেই দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধীর হয়ে যায়। যার ফলে, ২০১৯ সালে ৭৬ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত সরকারের অনুমোদন নেমে আসে।

তা সত্ত্বেও নির্বাচনী কর্মকর্তারা, আওয়ামী লীগকে ৭৫ শতাংশ ভোট সমেত বিজয়ী ঘোষণা করে। যদিও সেই নির্বাচন মারদাঙ্গা এবং প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছিল। হাসিনার এই দেখেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল, কারণ তাঁর বোঝা উচিত ছিল দেশে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাধঁছে। কিন্তু হাসিনা তবুও তাঁর স্বৈরাচারী মনোভাব জারি রেখেছেন। সরকারি চাকরির জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করা তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। জুলাই মাসে দেশ জুড়ে ছাত্ররা তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামে। যার ফলস্বরূপ বাংলাদেশের সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং হাসিনা নিজের প্রধানমন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

আরও পড়ুন: সন্দীপ ঘোষের বাড়িতে ওগুলো কী! তালিকা তৈরি করে ফেলেছে সিবিআই! দেখে থ তদন্তকারীরাও

প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হলে, বিরোধীরাও এর অংশ হয়ে পড়ে। সুশীল সমাজ থেকে চরমপন্থী ইসলামী সবাই এই বিক্ষোভে সামিল হয়। যা পরে প্রধানমন্ত্রীর অপসারণের দাবির বার্তা নিয়ে দেশ জুড়ে এক দাঙ্গায় পরিণত হয়। ৩০০-রও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, একশোরও বেশি মানুষ আহত হয়ে পড়েন। প্রায় ১০,০০০ জনকে কারারুদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়া মানেই ১৭১ মিলিয়ন মানুষের বাস বিশ্বের এই ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে স্থিতিশীলতা আসবে তা কিন্তু হলফ করে বলা যায় না বরং বলা চলে এর সম্ভবনা অনেকাংশে কম। বরং এই দেশে বর্তমানে ইসলামীদের দাপাদাপি বেড়ে যাওয়ার কারণে সামাজিক অস্থিরতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এর ফলে অর্থনৈতিক সংকট যেমন বাড়বে, তেমনই মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বাড়বে সঙ্গে জঙ্গিদের দৌরাত্ম্য বাড়বে বৈকি কমবে।

বাংলাদেশ সেনা সমর্থিত এই সরকার হয়তো এক থেকে দুই বছরের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করবে। তবে নির্বাচনের ফলাফল ও সময়সূচি বলা যায় না কখন প্রকাশ হবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই পার্টি ক্রমান্বয়ে দেশের দায়িত্বে ছিল। এই প্রথম ছাত্রদের হাত ধরে এগানো অন্তর্বর্তী সরকার গোটা দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলছে।

রাজনৈতিক পালাবদলের পরেই, সেনার তরফ থেকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে বিএনপি বর্তমানে বহু বিশৃঙ্খলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দলের কর্মীরাও দেশে একের পর এক হিংসা ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরী করে চলেছে। মহাম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে দেশের উদ্যোগপতিরা থাকলেও, তা নতুন এক দল তৈরী নির্বাচন অনুকূলে নিয়ে যেতে খুব একটা কাজে লাগবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। যদি এই সরকার, কোনও নির্বাচন ছাড়াই নিজেদের মেয়াদসীমা বাড়াতে চায়, স্বাভাবিকভাবেই অন্যন্য দলগুলির রোষের মুখে পড়বে মহম্মদ ইউনুসের প্রতিনিধিত্বে এগিয়ে চলা এই সরকার।

অর্থনৈতিক সংকট এবং ইসলামী অশুভ শক্তির উত্থান:
বাংলাদেশ বর্তমানে এক মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি এতটাই বেড়েছে যে তা ৯.৫ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই বাংলাদেশের বৈদেশিকী মুদ্রার সঞ্চয় কমেছে। তবে সরকারের তরফ থেকেও এর জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় ১৮.৪ বিলিয়ন ডলার, যা আমদানির ব্যয় মেটাতে ৩ মাসের জন্য যথেষ্ট।

বস্ত্র শিল্পের ট্রেড ইউনিয়ন, যারা প্রতিবাদের সময় পথে নেমেছিল, তারা বর্তমানের ন্যূনতম মাসিক বেতন বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যেই আর্জি করেছে। যদি অন্তর্বর্তী সরকার তাদের এই ডাকে সাড়া দেয় তবে বস্ত্র শিল্পের প্রতিযোগিতা ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে। যার ফলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থা আরও খারাপ অবস্থার দিকে যেতে পারে। এছাড়াও চীনের থেকে নেওয়া একাধিক লোন যা বিভিন্ন বড় প্রজেক্টে বিনিয়োগ করা হয়েছে সাথে IMF থেকে নেওয়া ঋণ যা বৈদেশিক মুদ্রার অভাব মিটিয়েছিল তাও পরিশোধ করতে হবে।

২০১৭ সাল থেকে মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা, বাংলাদেশে ঢুকছে যার ফলে দেশের সামাজিক সামঞ্জস্য নষ্ট হচ্ছে এবং সম্পদের পরিমাণও হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলিতে দিন কাটাচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার না করেই, মায়ানমার তাদের অধিবাসীদের দেশে ফেরাতে রাজি নয়।

শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার থাকাকালীন ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের কড়া হাতে দমন করেছিলেন, তেমনি এই সরকারকেও বাংলাদেশের ক্ষতিসাধন করা এইসব জেহাদিদের উৎখাতের দিকে নজর দেওয়া উচিত। শেখ হাসিনা উগ্রপন্থীদের রুখতে, কাউন্টার টেরোরিজম এবং ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (CTTCU) গঠন করেছিলেন। ইসলামীরা এর বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে দাবি তুলেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু আগের সরকারের ইসলাম বিরোধী বেশ কিছু নীতি বাতিল করেছে তাই বাংলাদেশে ধর্মীয় সন্ত্রাস আবার ফিরে আসতে পারে আশংকা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সদ্য হয়ে যাওয়া প্রতিবাদ-বিক্ষোভেও দেখা গেছে বাংলাদেশি হিন্দু ও বৌদ্ধদের উপর ইসলামীরা নক্কারজনক উপায়ে আঘাত হেনেছে।

বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে গোটা বিশ্ব:
এই পালাবদল বাংলাদেশের স্বার্থে একদমই মঙ্গলকর নয়। এর ফলে যেমন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব তৈরী হল তেমনই দেশের বিরোধী শক্তিগুলি সুবিধা পেল বাংলাদেশকে অবদমন করবার। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিবেশী এই দেশকে পুরোপুরি ভাবে সমর্থন করেছিল, যারফলে আওয়ামী লীগও ভারতের কাছে ভীষণ ভাবে কৃতজ্ঞ। বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন ও বিএনপি ভারতের সাথে শেখ হাসিনার এই আত্মীয়তা কখনোই ভাল ভাবে নেয়নি।

শেখ হাসিনার সরকার আমেরিকা আর চিনের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার সবসময় চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং অর্থনীতির উন্নতির জন্য চীন প্রায় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আমেরিকা বরাবরই চেয়েছে, চীনের সঙ্গে যেন বাংলাদেশের দূরত্ব তৈরী হয়, এবং বাংলাদেশ তাদের সাথে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে অংশ নেয়। ভারতের সাথে বাংলাদেশের যত দূরত্ব বাড়বে তত চীনের ভাল। শেখ হাসিনার অপসারণ চীনকে বাংলাদেশে উপর তাদের প্রভাব বিস্তারে আরও সাহায্য করবে। যার ফলে আমেরিকাকে পস্তাতে হতে পারে।