কলকাতাঃ পাম এভিনিউয়ের সাদামাটা, দু-কামরার প্রিয় ঘরই শেষ বাসস্থান হল রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের৷ সংস্কৃতিমনস্ক, সুবক্তা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যেদিন থেকে অসু্স্থ সেদিন থেকেই প্রর্থনার ঢল ওঠেছিল সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। তবে, বইয়ে আবিষ্ট দু-কামরার ঘরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন বুদ্ধবাবু।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্ম উত্তর কলকাতা ১ মার্চ ১৯৪৪। তাঁর পিতা নেপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য। ১৯৬১ সালে বুদ্ধদেব কলকাতার শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়)। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে বাংলা নিয়ে স্নাতক হন বুদ্ধদেব। স্কুল ও কলেজ জীবনে এনসিসি-র ক্যাডেট ছিলেন তিনি। পরর্বতী সময়, একটি সরকারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। আর কলেজ জীবনেই ছাত্র রাজনীতির সূত্রে সিপিআই(এম)-এ যোগ দেন তিনি।
কাকা সুকান্ত ভট্টাচার্যের থেকে পারিবারিক সূত্রে পাওয়া বামপন্থী ভাবনা থেকেই রাজনীতিতে যোগদান করেন তিনি। বই ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ দোসর। কাকা সুকান্ত ভট্টাচার্যের রেখে যাওয়া বই পড়েই বামপন্থা নিয়ে প্রবল আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। আর সেই থেকেই শুরু ‘সর্বহারা’ দলের প্রতিনিধিত্ব করা।
প্রথমে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সিপিআই(এম)-এর পলিটব্যুরো সদস্যও হন। তারপর, ১৯৭৭-এ প্রথম বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার সময়ই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মন্ত্রিসভায় তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বুদ্ধদেব। নভেম্বর ৬, ২০০০ সাল, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে প্রথম বারের জন্য বসেন তিনি। তবে, তা ছিল জ্যোতি বসুর অসুস্থতার কারণে বসা। কিন্তু ২০০১-এর ১৮ মে ত্রয়োদশ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক জীবন নিয়েও খুবই সচেতন ছিলেন তিনি। কয়েক দশক ধরে উত্তর কলকাতার পাম এভিনিউতে স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য ও মেয়ে সুচেতনা ভট্টাচার্যকে নিয়ে থাকতেন। সম্প্রতি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মীরা ভট্টাচার্যের একমাত্র সন্তান ‘সুচেতন’ ভট্টাচার্য’ হয়েছেন। তিনি তাঁর লিঙ্গ রূপান্তরিত করেছেন। তিনি, ঘর বেঁধেছেন তাঁর সঙ্গী সুচন্দার সঙ্গে। সুচেতন ভাট্টাচার্য একটি ইন্টারভিউ-তে বলেন যে, শারীরিক লিঙ্গ পরিচয় যাইহোক না কেন, ছোটবেলা থেকেই নিজেকে ছেলে মনে করা সুচেতন। ছোটবেলা থেকে পেয়েছে পারিবারিক প্রেরণা। তাঁর বাবাই তাঁকে ছোটবেলায় গালে সাবান লাগিয়ে দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে দিতেন।
২০১১ সালে মণীশ গুপ্তের কাছে পরাজয়ের পর, মিডিয়া, মানুষ পার্টি থেকে বহু দূরে চলে গেলেও তাঁর বিশ্বাষ ছিল বামপন্থার কোনও বিকল্প হয় না। তাঁর স্বপ্ন, তাঁর মূল্যবোধ বাঁচিয়ে রেখেছিল একটা গোটা যুব সমাজকে। নিজের সন্তানের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত সমর্থন করে তিনি প্রমাণ করেন তাঁর প্রগতিশীল চেতনার। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-কে নিয়ে সমালোচনা হয়েছে বারবার তবে, মানুষ বুদ্ধদেব কতটা খাঁটি তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার অবকাশ পায়নি কেউ।
কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া লোকসভা ভোটের সময়ও বারবার সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে একটাই আকুতি ছিল বামমনস্ক মানুষদের, দলের একটি মুখ প্রয়োজন। কারণ বাম থেকে ডানের বিশ্বাস বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিকল্প মুখ তৈরি করতে অক্ষম বামেরা। সেই, শূন্যস্থান আজ স্থায়ী, সব দায়িত্ব থেকে মুক্তি নিলেন তিনি। হঠাৎ, দূরে থেকে ভেসে আসছে ‘অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার’।