বিহারের সাসারামে ছেলেটার জন্ম। ছেলেকে কনস্টেবল বানাতে চেয়েছিলেন স্কুল শিক্ষক বাবা। ভাগ্যিস বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ না করে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ দেখে ক্রিকেটার হওয়ার শখ হয়েছিল ছেলেটার। না হলে ভারতের মানচিত্রে আকাশের উদয় হতো না। ভারতের হয়ে টেস্ট অভিষেকেই নজর কারা পারফরমেন্স।
আকাশ টেনিস বলে দারুন গতিতে বল করতে পারত। তবে গ্রামে সেরকম ক্রিকেটের পরিকাঠামো ছিল না। তাই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে নিয়ে পারি দিয়েছিলেন দিল্লি। সেখানে খুব একটা সুবিধা না করতে পেরে কলকাতায় চলে আসা। সিএবি দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাব ইউনাইটেডের হয়ে খেলা শুরু। সৌরভের ভিডিওকন একাডেমিতে সেই সময় অনুশীলন করতেন।
যদিও ক্রিকেট শেখার জন্য নয় মূলত তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল দ্বিতীয় ডিভিশনে ম্যাচ খেলানোর জন্য। তৎকালীন সেই একাডেমির এক কোচ সেকেন্ড ডিভিশনের ইউনাইটেড ক্লাবের দল গড়তেন ভিডিওকনের ছেলেদের নিয়ে। সেখান থেকেই আকাশের খবর জানতে পারেন অনূর্ধ্ব ২৩ বাংলার প্রথম কোচ হওয়া সৌরাশিস লাহিড়ী।
তার মধ্যেই ছয় মাসের ব্যবধানে বাবা এবং দাদার মৃত্যু। ঘাড়ের উপর ফ্যামিলির দায়িত্ব নিয়ে বিহার থেকে বাংলার অলিতে গলিতে টেনিস ক্রিকেট খেলা আর সেখান থেকে অনেক পথ পেরিয়ে ভারতীয় দল। ক্রিকেটের অ-আ-ক-খ কিছু না জানলেও দারুন গতিতে বল করতো আকাশ।
তৎকালীন অনূর্ধ্ব ২৩ নির্বাচকরা আকাশকে বাংলা দলে নিতে চাননি। তবে কোচ সৌরাশিস লাহিড়ীর জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত নিতে বাধ্য হন। অনূর্ধ্ব ১৬-১৯ কোন বিভাগে না খেললেও অনূর্ধ্ব ২৩ সি কে নাইডু টুর্নামেন্টে প্রথম বছরই নজর করেন। সেখান থেকে বাংলা সিনিয়র দলে।
প্রথমে মুস্তাক আলী টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে নিয়ম রক্ষার দুটি ম্যাচে খেলেন। তারপরেই গুজরাটের বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফি অভিষেকেই ছয় উইকেট। আর পিছনে ফিরে দেখতে হয়নি। তৎকালীন বাংলার কোচ অরুন লাল তারকা অশোক দিন্দার জায়গায় খেলার সুযোগ করে দেন। তারপর থেকেই যখনই খেলেছেন তখনই পারফর্ম করেছেন আকাশ।
ভারতীয় এ দলের হয়ে ইংল্যান্ড লায়ন্সের এর বিরুদ্ধে দু ম্যাচে ১১ উইকেট। তারপরই ভারতীয় দলে ডাক। বুমরা বিশ্রাম নেওয়ায় তার জায়গাতেই রাঁচিতে অভিষেক। মাঠে মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে নেমে পড়লেন প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে। প্রথম কয়েক ওভার ভালো বোলিং করলেও উইকেট আসে নি।
কথায় আছে ধৈর্যের ফল খুব মিষ্টি হয়,প্রথম ৩ ওভার উইকেট না পেলেও চতুর্থ ওভারে বোল্ড করেন ক্রলীকে, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নো বল হয় সেটি। ভেঙে না পরে, পরিশ্রম চালিয়ে যান, কয়েক ওভারের মধ্যেই ইংল্যান্ডের টপ ৩ কে পাঠিয়ে দেন প্যাভিলিয়নে, জ্যাক ক্রলি, বেন ডাকেট ও অলি পোপ। ম্যাচ শুরুর প্রথম ঘণ্টাতেই এত কিছু।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তাও আবার টেস্ট ম্যাচ। কিন্তু কোনওরকম নার্ভাসনেস ছিল বা আকাশ দীপের। প্রথম ওভার থেকেই গতি ও সুংইয়ের মিশ্রণে ইংরেজ ব্যাটরদের বিব্রত করতে থাকেন আকাশ। বাংলার পেসারের গতি ও সুইং সকলকে মুগ্ধ করে।
রাঁচিতে প্রথম দিনের শেষে ইংল্যান্ডের স্কোর ৩০২ রানে ৭ উইকেট। তারমধ্যে ৩ উইকেট নিয়েছেন আকাশ দীপ। দ্বিতীয় দিনের সকালে আবার আগুন ঝরাতে তৈরি আকাশ দীপ। অভিষেক টেস্টের আকাশের কাছ থেকে ফাইফার দেখার অপেক্ষায় বাংলা তথা গোটা দেশ।
রাঁচি: প্রথম দিনেই জমজমাট ভারত-ইংল্যান্ড রাঁচি টেস্ট। সকালে প্রথম সেশনটা ভারতীয় দলের নামে ছিল। আকাশ দীপের আগুনে স্পেল ও অশ্বিন-জাদেজার ঘূর্ণিতে লাঞ্চের আগেই ৫ উইকেট পড়ে যায় ব্রিটিশদের। কিন্তু পরের দুই সেশনে কামব্যাক করে ইংল্যান্ড। জো রুটের অনবদ্য সেঞ্চুরির সৌজন্যে দিনের শেষে ভাল জায়গায় ইংল্যান্ড। ৭ উইকেট হারিয়ে বেন স্টোকসের দলের স্কোর ৩০২ রান।
রাঁচিতে টস জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেয় ইংল্যান্ড। ভারতীয় দলে অভিষেক হয় বাংলার পেসার আকাশ দীপের। ব্যাট করতে নেমে ইনিংসের শুরুটা একেবারেই ভাল হয়নি ব্রিটিশদের। অভিষেক ম্যাচে জীবনের প্রথম স্পেলে দুরন্ত বোলিং করেন আকাশ দীপ। ইংল্যান্ডের ব্যাটিং টপ অর্ডারে জোর ধাক্কা দেন বাংলার পেসার। জ্যাক ক্রলি, বেন ডাকেট ও অলি পোপকে সাজঘকে পাঠান আকাশ দীপ। প্রথম সেশনে অপর দুটি উইকেট নেন অশ্বিন ও জাদেজা। লাঞ্চ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের স্কোর ছিল ১১২ রানে ৫ উইকেট।
দ্বিতীয় সেশন থেকে ঘুড়ে দাঁড়ায় ইংল্য়ান্ড। বাজবল ক্রিকেট ছেড়ে জো রুট ঠান্ডা মাথায় আদর্শ টেস্ট ক্রিকেটের স্টাইলে ব্যাটিং শুরু করেন। তাকে যোগ্য সঙ্গ দেন বেন ফোকস। ঠান্ডা মাথায় ব্যাটিং করে শতরানের পার্টনারশিপ করেন রুট ও ফোকস। দ্বিতীয় সেশনে একটিও উইকেট হারায়নি ইংল্য়ান্ড। চা বিরতিতে ইংল্যান্ডের স্কোর ১৯৮ রানে ৫ উইকেট।
আরও পড়ুনঃ Sachin Tendulkar: ভূস্বর্গে ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’, সারা-অঞ্জলির সঙ্গে তুষারপাত উপভোগ সচিনের, রইল সেরা ছবি
দিনের শেষ সেশনে রানের গতিবেগ কিছুটা বাড়ায় ইংল্যান্ড। ২২৫ রানে ষষ্ঠ উইকেট পড়ে। ৪৭ রান করে মহম্মদ সিরাজের শিকার হন বেন ফোকস। এরপর টম হার্টলি ক্রিজে আসলেও বেশি সময় থাকতে পারেননি। ১৩ রান করে সিরাজের দ্বিতীয় শিকার হন তিনি। এরপর জো রুটকে সঙ্গ দেন অলি রবিনসন। অর্ধশতরানের পার্টনারশিপ করেন ২ জন। নিজের শতরান পূরণ করেন রুট। দিনের শেষে রুট ১০৬ ও রবিনসন ৩১ রানে অপরাজিত।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্বপ্নের অভিষেক হল বাংলার আকাশ দীপের। রাঁচিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কেরিয়ারের প্রথম টেস্টের প্রথম স্পেলে ৩ উইকেট নিলেন বাংলার পেসার। আগুন ঝরানো স্পেলে মুগ্ধ করলেন সকলকে। (Photo Courtesy- AP)
চতুর্থ টেস্টে জসপ্রীত বুমরাহকে বিশ্রাম দিয়েছে ভারতীয় দল। ফলে বুমরাহের জায়গা কে নেবে বা অভাব কে পূরণ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু সেই অভাব ঢেকে দিলেন আকাশ দীপ। লাঞ্চের আগেই ইংল্যান্ড টপ অর্ডারকে ধসিয়ে দেন তিনি। (Photo Courtesy- AP)
ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারেই জ্যাক ক্রলিকে বোল্ড করেন আকাশ দীপ। কিন্তু নো বল হওয়ায় বেঁচে যান ব্রিটিশ ব্যাটার। আফশোস হলেও প্রথম উইকেট শিকার করতে বেশি দেরি করেননি আকাশ দীপ। (Photo Courtesy- AP)
নিজের পঞ্চম ওভারে আকাশ দীপের প্রথম শিকার হন বেন ডাকেট। আকাশ দীপের আউট সুইং বুঝতে না পেরে ধ্রুব জুরেলের হাতে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন ডাকেট। একই ওভারে অলি পোপকেও আউট করেন আকাশ দীপ। এলবিডব্লুউ আউট হন তিনি। (Photo Courtesy- AP)
আকাশ দীপের তৃতীয় শিকার হন জ্যাক ক্রলি। তাকে বোল্ড করেন আকাশ দীপ। পেস ও সুইংয়ের যে মিশ্রণ দেখা গিয়েছে আকাশ দীপের বলে তা অনবদ্য। দেখে বোঝার উপায় ছিল না কেরিয়ারের প্রথম টেস্টে বল করছেন বঙ্গ পেসার। (Photo Courtesy- AP)
তিনি খেলেন বাংলার হয়ে। তবে আদতে তিনি বিহারের। আকাশ দীপ এবার খেলবেন ভারতীয় টেস্ট দলে! ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে ডাক পেয়েছেন তিনি।
আকাশ দীপ মিডিয়াম পেসার। মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করতে পারেন। ব্রেট লি তাঁর আদর্শ। তবে ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে সচিন তেন্ডুলকরকে তিনি গুরু বলে মনে করেন।
২০১৩ সালে আকাশ দীপ কলকাতায় থাকার সময় তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। এর পর কয়েক মাসের মধ্যে দাদার মৃত্যু। পর পর দুটি ধাক্কা আকাশ দীপ সামলেছিলেন অনেক কষ্টে।
ইংল্যান্ডের ক্লাবের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া এ-র হয়ে আকাশদীপ দুই ম্যাচ ১৩টি উইকেট নেন। ৪৬ রানও করেন। সেই পারফরম্যান্সের পরই তাঁর ভাগ্যের শিঁকে ছিড়ল।
বাবা, দাদার মৃত্যুর পর আকাশ দীপের মা তাঁকে কলকাতায় আসতে দিতে চাননি। তবে আকাশ দীপের এক বন্ধুর কথা মেনে নিয়ে তাঁর মা শেষ পর্যন্ত রাজি হন। কলকাতায় এসে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ট্রেনিং শুরু করেন তিনি।
বিহারের রোহতাস জেলার বদ্দি গ্রামের ছেলে আকাশ দীপ। ২০১৬ সালে ইউনাইডেট ক্লাবের হয়ে খেলেন। সেই মরশুমে ৪২টি উইকেট নেন তিনি।
২০১৮-১৯ মরশুমে আকাশ দীপ মুস্তাক আলি টুর্নামেন্টের জন্য নির্বাচিত হন। ২০১৯ সাল থেকে তিনি রঞ্জি, বিজয় হাজারে, মুস্তাক আলি-সহ একাধিক টুর্নামেন্টে বাংলার হয়ে ক্রমাগত ম্যাচ খেলেন। আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের হয়ে খেলেন। সৌরভের অ্যাকাডেমিতে ট্রেনিং শুরুই তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়, এ কথা স্বীকার করেন আকাশ দীপ নিজেও। ২০২৩ রঞ্জি ট্রফিতে দেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হয়েছিলেন।
Just another WordPress site