উত্তর ২৪ পরগনা: বাড়িতে অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ হোক বা শেষ পাত, সব ক্ষেত্রেই বাঙালিদের দইয়ের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আর বিয়েবাড়ি হলে তো কোনও কথাই নেই, শুরু হয় দধিমঙ্গল দিয়ে, আর ভোজের উপসংহার টানে মিষ্টি দই। তাই বাঙালির যে কোনও শুভ কাজে দই কিন্তু অপরিহার্য। আর দইয়ের স্বাদে মজেননি এমন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর। শেষ পাতে একটু মিষ্টি ছাড়া বাঙালি যেন অসম্পূর্ণ। মিষ্টির নানা ধরন থাকলেও, বাঙালির অনুষ্ঠানে প্রাচীন কাল থেকেই জায়গা করে নিয়েছে দুধের তৈরি বিশেষ এই দই।
রাজ্যের নানা প্রান্তের টক, মিষ্টি, ক্ষীর দইয়ের কথা শুনলেও, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সীমান্ত এলাকা বনগাঁর কাঁচাগোল্লা, মাখা সন্দেশ ছাড়াও, এই বিশেষ দই-এর জন্যও বিখ্যাত। বনগাঁর বিখ্যাত কাঁচাগোল্লার কথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও শোনা গিয়েছে। তবে বনগাঁর বিখ্যাত এই চন্দ্রচূড় দই কিন্তু চাইলেই সব দোকানে পাওয়া যায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে বর্তমান পরিস্থিতি, কিন্তু এই চন্দ্রচূড় দই হারায়নি তার ঐতিহ্য।
তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক এই দই তৈরির ইতিহাস। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে বনগাঁর যোগেন চন্দ্র ঘোষ আবিষ্কার করেন বিশেষ এই চন্দ্রচূড় দই এর। বর্তমানে ঘোষ পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম বিশেষ এই চন্দ্রচূড় দই প্রস্তুত করে বনগাঁর ট বাজারে ঐতিহ্যবাহী কার্তিক মিষ্টান্ন ভান্ডার দোকানটি সামলাচ্ছেন। সারা বছরই এই দইয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও, উৎসবের দিনগুলিতে ক্রেতাদের চাহিদা সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় দোকান মালিককে। বাড়িতে অতিথি এলে, বা কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি ভিন রাজ্যে ঘুরতে গেলেও অনেকেই উপহারস্বরূপ নিয়ে যান বনগাঁর কাঁচাগোল্লার সঙ্গে এই চন্দ্রচুড় দই।
এই দইয়ের আবিষ্কর্তা যোগেন চন্দ্র ঘোষ তৎকালীন সময়ে বাঁকে করে দুধ নিয়ে এসে, সেই দুধ জ্বাল দিয়ে নিজে হাতে দই পাততেন। ধরা যাক, ৫০ কেজির দুধ জাল দিয়ে সেটিকে নিয়ে আসা হতো ৩০ কেজিতে। ফলে ওই দুধে একটি ক্ষীর ভাব আসতো। এমনকি সেই দই পেতে বরফি আকারে কেটে “বরফি সন্দেশ” হিসেবেও বিক্রি হতো। বিশেষ এই দইয়ে কোনওরকম জল কাটত না ও গলতও না। দইয়ের মধ্যে থেকেই বিশেষ ক্ষীরের গন্ধ পাওয়া যেত। সেই থেকেই এই দইয়ের নাম দেওয়া হয় চন্দ্রচুড় দধি বা দই। বর্তমানে সেই সময়ের মতো দুধ পাওয়া না গেলেও, এখনও প্রতিদিন নিয়ম করে বিশেষ ওই প্রক্রিয়া মেনেই তৈরি হয় চন্দ্রচূড় দই বলেই জানালেন বর্তমান দোকান মালিক অলোক ঘোষ। ১৮০ টাকা কিলো প্রতি বিক্রি হয় এই বিখ্যাত চন্দ্রচূড় দই।
তবে চেখে দেখতে চাইলে ছোট কুড়ি টাকার খুঁঁড়িও রয়েছে বলে জানান দোকান মালিক। পাশাপাশি তিনি আরও দাবি করেন, পূর্বপুরুষের তৈরি ঐতিহ্যের এই চন্দ্রচূড় দই বানানোর ক্ষেত্রে কোনও রকম আপোষ করা হয়না। মুখে দিলেই অন্যান্য দইয়ের থেকে এই দই যে অনেকটাই আলাদা তা অনায়াসে বুঝতে পারেন ক্রেতারা। কলকাতা-সহ রাজ্যের নানা প্রান্তের পাশাপাশি সুদূর বাংলাদেশ থেকে আগত মানুষজনও এই বিশেষ চন্দ্রচুড় দই চেখে দেখতে পৌঁছে যান বনগাঁর ট বাজারের কার্তিক মিষ্টান্ন ভান্ডারে। জামাইষষ্ঠী হোক বা বাড়ির বিশেষ কোনও উৎসব, আগে থেকে অর্ডার দিয়ে ক্রেতারা নিয়ে যান এই দই। নতুন এ প্রজন্মে বাজারে নানা আধুনিক মিষ্টি আসলেও জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি বনগাঁর কাঁচাগোল্লা ও চন্দ্রচূড় দইয়ের। তাই এই দইয়ের স্বাদ নিতে চাইলে আপনাদের আসতে হবে শিয়ালদহ বনগাঁ শাখার প্রান্তিক স্টেশনে।
Rudra Narayan Roy