বনগাঁ: ভারত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী লোকসভা কেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্র। এই কেন্দ্রের অন্তর্গত পেট্রাপোল স্থল বন্দর, যা দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক পণ্য আদান-প্রদান থেকে যাত্রী পরিবহনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি, বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে বাংলার মতুয়া আন্দোলন।
উত্তর ২৪ পরগণার অন্তর্গত নবগঠিত লোকসভা কেন্দ্র হল বনগাঁ। ২০০৯ সালে আসন পুনর্বিন্যাসে বারাসত লোকসভা ভেঙে তৈরি হয় এই কেন্দ্র। যদিও বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রটি নদিয়া জেলা ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। ৭ বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত বনগাঁ লোকসভা। যেগুলি হল কল্যাণী, হরিণঘাটা বিধানসভা কেন্দ্র, বনগাঁ উত্তর, বনগাঁ দক্ষিণ, বাগদা বিধানসভা কেন্দ্র এবং গাইঘাটা ও স্বরূপনগর বিধানসভা কেন্দ্র। এবার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এই লোকসভা কেন্দ্র গঠনের পর থেকে কেমন ছিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
আরও পড়ুনঃ বাঁকুড়া গেলেও এই জায়গায় যাওয়া হয়নি? দ্বিতীয় বৃন্দাবন ঘুরে আসুন গরমের ছুটিতেই
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্র তৈরির পর থেকেই এই কেন্দ্রটি ছিল তৃণমূলের দখলে। পরপর ১০ বছর এখান থেকে তৃণমূলের প্রতিনিধিরাই নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৯ সালে এই কেন্দ্রের প্রথম নির্বাচনে জিতেছিলেন গোবিন্দচন্দ্র নস্কর। পরের নির্বাচনে জেতেন মতুয়া সম্প্রদায়ের বড়মা বীণাপাণি দেবীর ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর। কিন্তু, নির্বাচনে জেতার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর জীবনাবসান হয়। পরবর্তীকালে, বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে উপ নির্বাচনে জিতে সাংসদ হন তার স্ত্রী মমতাবালা ঠাকুর।
বলে রাখা ভাল, রাজনীতির সমীকরণেও বর্তমানে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কে দু’টি ভাগ রয়েছে। বিজেপির দিকেও যেমন ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে এখানে, তেমনই রয়েছে তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্ক। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দেশজুড়ে চর্চা মাঝেই বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের গুরুত্ব আরও বহু গুণ বেড়েছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ২০০৯ সালে বনগাঁ লোকসভা নির্বাচনে অবশ্য ঠাকুরবাড়ির কোনও সদস্যকে প্রার্থী না করে, তৃণমূল পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ রাজনীতিক গোবিন্দচন্দ্র নস্করকে নির্বাচনী লড়াইয়ে ময়দানে নামায়।
অতীতে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভাতেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছিলেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতাকেই ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে বনগাঁয় ব্যবহার করেছিল তৃণমূল। সাফল্যও মিলে ছিল হাতেনাতে। ৫ লক্ষ ৪৬ হাজার ভোট পেয়েছিল তৃণমূল। প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থী কৃষ্ণপদ মজুমদার সেই সময় পেয়েছিলেন ৪২ হাজার ৬১০ ভোট।
এরপর ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের সময় থেকেই ঠাকুরনগর ঠাকুরবাড়ি ও মতুয়া ভোট ব্যাঙ্ক হাতিয়ার করে, মতুয়া মহাসংঘের সংঘাধিপতি কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরকে প্রার্থী করে তৃণমূল। ৫ লক্ষ ৫১ হাজার ২৩১ ভোট পান তিনি। মোদি ম্যাজিকের হাত ধরে লোকসভা ভোটে বনগাঁতেও শক্তি বাড়িয়েছিল বিজেপি। ২ লক্ষ ৪৪ হাজার ৭৮৩ টি ভোট পেয়েছিলেন বনগাঁর সেই সময়ের বিজেপি প্রার্থী কেডি বিশ্বাস। কিন্তু এরপর কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর সাংসদ থাকাকালীন অবস্থাতেই প্রয়াত হন। আর তাই ২০১৫ সালে বনগাঁ লোকসভায় উপনির্বাচন হয়। সেবারও তৃণমূল ফের বেছে নেয় ঠাকুরবাড়ির অন্যতম সদস্য মমতাবালা ঠাকুরকে। প্রায় ৫ লক্ষ ৪০ হাজার ভোট পান তিনি।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি যে বনগাঁয় নিজেদের শক্তি বাড়াচ্ছে তা ২০১৪ সালের ভোট এবং ২০১৫ সালের উপনির্বাচনের পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এরপর ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী করে মতুয়া ঠাকুরবাড়ির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শান্তনু ঠাকুরকে। সেবার, নির্বাচনী লড়াইয়ে মুখোমুখি হন ঠাকুরবাড়ির দুই সদস্য। একদিকে তৃণমূলের মমতাবালা ঠাকুর, অন্যদিকে বিজেপির শান্তনু ঠাকুর। ভোটে শান্তনু পান ৬ লক্ষ ৮৭ হাজার ৬২২ টি ও প্রতিদ্বন্দ্বী মমতা বালা ঠাকুর পান ৫ লক্ষ ৭৬ হাজার ০২৮ টি ভোট। প্রায় এক লক্ষের বেশি ব্যবধানে যেতেন বিজেপির তুরুপের তাস শান্তনু ঠাকুর। ২০১৯ এর নির্বাচনে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১৭ লক্ষ ৪ হাজার ৬৩২। এবারও ২০২৪ এর নির্বাচনে লড়াই মূলত দ্বিমুখী। তৃণমূল বনাম বিজেপি। তবে এবার আর মমতাবালাকে প্রার্থী করেনি তৃণমূল।
সম্প্রতি মমতাবালাকে রাজ্যসভার সাংসদ করা হয়েছে। সেই জায়গায় বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনে জয়ী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো শান্তনু ঠাকুরের উপরই আস্থা রেখেছে। তৃণমূল অবশ্য বাগদা কেন্দ্র থেকে বিধানসভায় বিজেপির টিকিটে জয়ী হয়ে দলবদল করে পরবর্তীতে তৃণমূলে আসা বিশ্বজিৎ দাসের উপরই বাজি ধরেছে। ফলে ঠাকুরবাড়ির সদস্য শান্তনু ঠাকুরই এবার একমাত্র ভোট ময়দানে।
২০২৪ এর নির্বাচনে সংরক্ষিত বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ১৮ লক্ষ ৩৬ হাজার ৩৭৪ জন। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার রয়েছেন ৯ লক্ষ ৩৪ হাজার ৮৮৪ জন এবং মহিলা ভোটার রয়েছেন ৯ লক্ষ ১ হাজার ৪১৯ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন মাত্র ৭২। বনগাঁ লোকসভা এলাকায় মোট ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের সংখ্যা ১৯৩০, যার মধ্যে ৫৫০ কেন্দ্র স্পর্শকাতর বলেই জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-সহ নির্দল প্রার্থী মিলিয়ে নমিনেশন জমা দিয়েছেন মোট ১৫ জন। দেশে নাগরিকত্ব আইন পাসের পর মতুয়া ভোট ব্যাংক এখন কোন দিকে রায় দেয়! বিশ্বজিৎ না শান্তনু এখন শেষ হাসি কে হাসে, সেদিকেই তাকিয়ে বনগাঁ লোকসভা।
Rudra Narayan Roy