নয়াদিল্লি: বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বের চট্টগ্রাম অঞ্চল। এই বিভাগের পার্বত্য চট্টগ্রাম; মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য গোটা বিশ্বের পর্যটন প্রিয় মানুষের কাছে অন্যতম এক গন্তব্যস্থল। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে ১১টি আদিবাসী গোষ্ঠীর বাস, যা দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়ে।
পাকিস্তান সরকার 1900 সালের চট্টগ্রাম পার্বত্য আইন একটি সংশোধনীর মাধ্যমে রদবদল ঘটিয়ে সেখানকার আদিবাসী জনগণের ঐতিহ্যবাহী জমির অধিকার কেড়ে নেয়। ঠিক তার পরের বছরেই, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের জন্য 100,000-এরও বেশি আদিবাসীদের অন্যায় ভাবে উচ্ছেদ করা হয়।
1971 সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও, চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থান স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়নি। ওই অঞ্চলের পার্বত্য জাতিগোষ্ঠীরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে বলে অনেক আশা করেছিল। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানেও আদিবাসী জনগণের নিজস্ব জাতিগত পরিচয় কোনও স্বীকৃতি পায়নি।
আরও পড়ুন: কিছু কিছু টয়লেটের বাইরে লেখা থাকে WC… জানেন এই WC-এর অর্থ কি?
এমনতর পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত বাঙালিদের পুনর্বাসন ঘটতে থাকে। 1979 থেকে 1985 সালের মধ্যেকার বছরের ভেতর কম করে 40,000 জাতিগত ভাবে বাঙালি পাহাড়ে জায়গা করে নেয়। যার ফলে খুব তাড়াতড়ি জনগোষ্ঠীর অনুপাত বদলাতে শুরু করে। এর ফলে ওই অঞ্চলে জাতিগত সংঘর্ষেরও সূচনা হয়।
পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম একাধিকবার হিংসার সম্মুখীন হয়। দুই দশক অর্থাৎ 1990 সালের মধ্যে জাতিগত বাঙালি পুনর্বাসিতরা পাহাড়ের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। বাংলাদেশে সামরিক শাসন শেষ হওয়ার পর এবং 1991 সালে নাগরিক সরকার প্রতিষ্ঠার পর, পাহাড়ের শান্তি বাহিনী এবং বাংলাদেশের সরকারের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। তবে, শেখ হাসিনা 1996 সালে প্রধানমন্ত্রী পদে আসার পরই আলোচনাগুলো সদর্থক দিকে যেতে শুরু করে। 1997 সালে চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পাহাড়ের দীর্ঘ সশস্ত্র সংঘাতের সমাপ্তি ঘটায়। শান্তি চুক্তিটি প্রধানত তিনটি মূল দিক অন্তর্ভুক্ত করে—আদিবাসী বসবাসকৃত অঞ্চলের সুরক্ষা; সিএইচটির স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষমতায়ন; এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত আদিবাসীদের পুনর্বাসন।
যতই কথাবার্তা এগোক না কেন সিএইচটি (চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকা) চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে সব সরকারেরই উদাসীনতা প্রকাশ পেয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে এই চুক্তির কোনও উল্লেখযোগ্য বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের পরও সেখানকার সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি এই ইঙ্গিত দেয় যে, আদিবাসী জনগণের কল্যাণ ও উন্নয়নকে উপেক্ষা করছে।
এছাড়া, সরকারিভাবে বাঙালিদের স্থানান্তর সীমিত করার ব্যাপারে সরকারের উদাসীন মনোভাব সিএইচটির আদিবাসী জনগণের অসন্তোষকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। 2016 সালের ভূমি কমিশনের সংশোধনী, যা আদিবাসী জনগণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং ভূমি বিরোধ সিএইচটির আইন, অনুশীলন ও রীতির মাধ্যমে সমাধান করবে বলে উল্লেখ করে, তা বাঙালি অভিবাসীদের প্রতিবাদ বাড়িয়ে তোলে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত তার আদিবাসী জনগণকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেয় না এবং সকল নাগরিককে ‘বাঙালি’ হিসেবে অভিহিত করে, যদিও সিএইচটির আদিবাসী জনগণের মধ্যে (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো) ভাষাগত বৈচিত্র চোখে পড়ার মতো।
যদিও 1997 সালের চুক্তিটি সিএইচটিতে সশস্ত্র সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটায়, তবুও আদিবাসী এবং অভিবাসী বাঙালি জনগণের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক আজও রয়েছে। বারবার ঘটে যাওয়া সিএইচটিতে হিংসার ঘটনাগুলি এই বিষয়টি মেলে ধরে। দুই মাস আগে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলন দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার, যেটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উপদেষ্টাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে (আওয়ামী লীগ বাদে) এবং যার প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূস, দেশে স্বার্থের জন্য বর্তমানে কাজ করে চলেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যা দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতির মাধ্যমে স্পষ্ট হয়। বিভিন্ন হিংসার ঘটনা আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সিএইচটিতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হিংসার ঘটনা স্পষ্ট করে আদিবাসী জনগণের বহুদিনের অসন্তোষগুলির এখনও সমাধান হয়নি। মানবাধিকারের লঙ্ঘনের অভিযোগ এই সরকারের বিরুদ্ধে উঠতে শুরু করেছে। সেই হিংসার ঘটনা থেকে চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকাও বাদ যায়নি। বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার কি সত্যিই পারবে পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের অশান্তি শান্ত করতে?