উত্তরবঙ্গের খাদ্য সংস্কৃতি

Traditional Cuisine: বাঁশের চোঙায় কাঁচা দুধের গলেয়া দই বা পাতায় মোড়া টোপলা ভাত আজ বিস্মৃত! আধুনিকতায় ঢেকে যায় খাবারের থালা

সুরজিৎ দে, জলপাইগুড়ি: আধুনিক খাদ্য সংস্কৃতিই ডেকে আনছে রোগ-জ্বালা! আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে উত্তরের খাদ্য সংস্কৃতি। এতেই কি বাড়ছে শরীরের রোগব্যাধি ? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা? কেমনই বা ছিল পুরাকালে উত্তরের খাদ্য সংস্কৃতি? আগে উত্তরবঙ্গের খাবারদাবারের মধ্যে ছিল এক অন্য বৈশিষ্ট্য।

কলাপাতায় টক দই থেকে শুরু করে ভাদই ধানের মিষ্টি, লাল চিঁড়ে, সঙ্গে আখের গুড়। শেষ পাতে  থাকত কাঁসার থালায় সাজানো ‘গুয়া পান’, সুপারি হিসেবে থাকত মাটিতে পুঁতে পচানো সুপরি ‘মজাগুয়া’। সবেতেই ছিল প্রকৃতির ছোঁয়া। নির্ভেজাল হওয়ায় রোগ ব্যাধি নিবারণে এইসব খাবারদাবারের কিন্তু জুড়ি মেলা ভার।কিন্তু,এখন ব্যস্ত জীবনে জায়গা করে নিয়েছে নানা আধুনিক খাবার। বিলুপ্তির পথে উত্তরের নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তরের ঋতুভিত্তিক খাদ্য সংস্কৃতি এভাবে বিপন্ন বলেই বাড়ছে রোগব্যাধি। এখন সকালের ব্রেকফাস্ট হোক কিংবা অতিথি আপ্যায়ন-ডিমের অমলেট, টোস্ট, স্যান্ডউইচ, লুচি -পরোটা সহ অন্যান্য স্ন্যাকসই জায়গা দখল করেছে। হেঁসেলের ছবিতেও এসেছে ভোলবদল! আগে রান্নাঘর মানেই চালের উপর দিয়ে থাকবে বেড়ে ওঠা লাউ, কুমড়ো, ঝিঙের লতা। উত্তরের সবুজ ধ্বংস করে কংক্রিটের জঙ্গল বাড়ছে ক্রমশই। উঠছে বড় দালান আর ভেতরে মডিউলার কিচেন।

এখন আর দেখা যায় না পাতায় মুড়ে রাখা “টোপলা ভাত”। তেল হলুদ ছাড়া স্বাস্থ্যকর পদ “লাফাশাক” কিংবা “সজনে ও কচুপাতার ছেঁকা”। “পেলকা” ও “ফোকতই” পদের নাম এখনকার প্রজন্মের কাছে এক্কেবারেই অজানা। কিন্তু জানলে অবাক হবেন, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে এই রেসিপিরই ছিল জয়জয়কার। পেট ঠাণ্ডা রাখতে ‘কলার ধুলো’ নামে পরিচিত ওই ভেষজ সোডা ছ্যাকা, পেলকা ও ফোকতই রান্নায় ব্যবহার করা হত। ফোকতই রেসিপিতে কপি, আলুর জুসের সঙ্গে জুড়ত শুকনো মাছের গুড়ো। এখন তা বিরল। বরং, পাতে উঠছে মিলে ছাটা সরু চালের ভাত, শাক, মাছের কালিয়া, মাংসের নানা পদ, ঝুড়ি আলু ভাজা।

আরও পড়ুন : আজ অন্নদা একাদশী! বৃহস্পতিবার ভাদ্রমাসের সর্বশ্রেষ্ঠ এই একাদশী তিথি কত ক্ষণ আছে? শুভ সংযোগের মুহূর্ত কখন? জানুন পঞ্জিকা কী বলছে

উপরন্তু, এই রান্না গুলিও বাড়িতে করার ঝক্কিতে ভরসা হয়েছে রেস্টুরেন্টের থালি।মাটির হাঁড়ি অথবা ককেয়া বাঁশের চোঙায় কাঁচা দুধের তৈরি গলেয়া দই এখন দুষ্প্রাপ্য। অতিথিবরণে তাই দোকানের মিষ্টি দই ভরসা হয়েছে। এ বিষয়ে জলপাইগুড়ির হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক দিলীপ গুহ বলেন, “আগে উত্তরবঙ্গের খাদ্য সংস্কৃতিতে ছিল প্রাকৃতিক স্পর্শ। প্রত্যেক ঋতুভিত্তিক খাবারে ছিল প্রাকৃতিক ঔষধের মতো বিশেষত্ব। যেমন- ফাল্গুনে গলেয়া দই অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করত। বসন্তরোগ থেকে রক্ষা পেতে এই পদের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এখন উত্তরের গ্রামীণ এলাকার খাদ্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। সবই পাল্টেছে। তাই রোগব্যাধিও বেড়েছে। এখন মানুষ প্রাকৃতিক ঔষধের ওপর নির্ভর করার চাইতে নির্ভর করতে হচ্ছে কেমিক্যাল ঔষধের উপর।”

এখনও উত্তরবঙ্গের প্রবীণ ব্যক্তিত্বরা মনে করেন পুরাকালের সেই ঐতিহ্যবাহী খাদ্য সংস্কৃতির কথা। তার সঙ্গে হয়তো তাল মেলাতে পারেন না আধুনিক নিত্যনতুন খাবার-দাবারের। এভাবেই হয়তো সময়ের সঙ্গে পাল্টে যায় খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে মানুষের জীবন যাপনের পদ্ধতি।