প্রতিবছর দুর্গাপুজোর আগমনে প্রবাসী বাঙালিদের মনে জেগে ওঠে ফেলে আসা স্মৃতি। জাকার্তায় বাঙালিরা এই অনুভূতির ব্যতিক্রম নয়। পুজোর চারটি দিন যেন বাঙালির হৃদয়ে ঢেউ তোলে এক অনির্বচনীয় আনন্দের। শিউলি ফুলের গন্ধ, ভোরের ঠান্ডা হাওয়া কিংবা কলকাতার মতো জাঁকজমকপূর্ণ প্যান্ডেল না হলেও – এত না-এর মধ্যে সবটাই যেন এক মিলন উৎসব। তাতে রয়েছে এক অদ্ভূত উষ্ণতা ও আন্তরিকতা।
পুজোর দিনগুলোতে মনে হয়, মাতৃভূমি আর প্রবাস এক হয়ে যায়। ঢাকের তালে, প্রতিমার সামনে পুজোর আনুষ্ঠানিকতা, আর উৎসবের মেলা – সবকিছু মিলে যেন দূরত্বের পরাজয় ঘটে। জাকার্তায় দুর্গাপুজো যেন শুধু বাঙালিদের জন্য নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক মহা উৎসব আর স্থানীয় ইন্দোনেশিয়ান বন্ধুদের জন্য এক মহামিলন।
জাকার্তা বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন গত ৪২ বছর ধরে জাকার্তায় দুর্গাপুজোর আয়োজন করে আসছে। এ বছর পুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সূচনা করছেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সন্দীপ চক্রবর্তী এবং তাঁর স্ত্রী তরুণা চক্রবর্তী। তাঁদের উদ্দীপনা দেখেও সবাই অভিভূত। JABA-র সভাপতি সুব্রত মুখোপাধ্যায় অসাধারণ উদ্যম নিয়ে, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও সাংস্কৃতিক জগতের মানুষকে একত্রিত করে এই পুজোকে করে তুলেছেন একটি আন্তরিক উৎসব।
পুজোর সহ-সভাপতি অভিজিৎ মহাপাত্র বলেন, ”প্রতি বছরের মতো এবারের পুজোতেও নতুন প্রজন্ম আনন্দে মাতোয়ারা। যারা হয়তো কখনই দেশে দুর্গাপুজো দেখেনি, ফের তাঁদের কাছে এ যেন মিলন উৎসব। এই মধুর স্মৃতি তাদের জীবনে এক অমূল্য সম্পদ। নতুন প্রজন্ম, নতুন দেশ, নতুন অভিজ্ঞতা – সকল ভৌগোলিক সীমানা ছিন্ন করে হৃদয়ের মাঝে ভালোবাসার ঐকতান সম্পর্ককে দৃঢ় করবে ফের।
মাতৃভূমি থেকে দূরে থেকেও, JABA-র মুখ্য সচিব টিনটো বক্সী প্রতি বছরের মতো কুমারটুলি থেকে মাটির প্রতিমা, সোদপুর থেকে ঠাকুরমশাই, খানসামা, রাঁধুনি, পুজোর সামগ্রী, আতপ চাল সহ নানান প্রয়োজনীয় সামগ্রী উড়িয়ে এনেছে, যা সহজে ইন্দোনেশিয়াতে পাওয়া যায় না। এই পুজো দেখিয়ে দেয় যে, দুর্গাপুজোর আসল আনন্দ কোনও নির্দিষ্ট শহর বা স্থানকেন্দ্রিক নয়, তা আসলে হৃদয়ের গভীরের উৎসব। আবালবৃদ্ধবনিতা এই চার দিন মেতে ওঠে পুজোর উন্মাদনায়।
কলকাতা থেকে আসে মহিলাদের জন্য গরদের শাড়ি, নাচের সাজসজ্জা, ধুনুচি আরও কত কী! তিন মাস আগে থেকে চলে ‘পূরবীদি’র নাচের অনুশীলন। এবারও JABA-র আরেকটি শাখা – “দূর্গা বাহিনী” ডেজই মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায় অসহায় এবং দুঃস্থ পরিবারকে সাহায্য করতে তৎপর। সৌমেন চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে পুরনো রাজস্থানি রাজপ্রাসাদের আদলে প্যান্ডেল সেজে উঠেছে। কমিটির তরফ থেকে পাঁচ দিনের জন্য সকাল-সন্ধ্যা থাকবে খাওয়াদাওয়ার সুবন্দোবস্ত।
রাজীব দে সরকার, সূর্য চক্রবর্তী, অরিত্রর মতো কর্মঠ সদস্যদের পর্যবেক্ষণে এই কতগুলি দিন হয়ে উঠবে শতভাগ খাঁটি বাঙালি উৎসব। জাকার্তা শহরে এটি একমাত্র দুর্গাপুজো বলেই দর্শনার্থীদের ভিড় কয়েক হাজারের উপর হবে বলে আশা করছেন আয়োজকরা। সহকারী সচিব সৌমিক চৌধুরী ও চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ এই পুজো আর্থিক ভাবেও সাফল্য লাভ করেছে। অবশেষে JABA-র বাৎসরিক পত্রিকার সম্পাদক সৌরভ বেরা বলেন, ”JABA-র জাগরণী বার্তা নৈতিক অবক্ষয়ের অন্ধকার ভেদ করে মানবতার জন্য বয়ে আনুক এক নতুন দিগন্ত। আমাদের অনুভূতির সন্ধানে-মন্থন করতে হবে প্রকৃতি আর মন। তাই জাতি ধৰ্ম নির্বিশেষে সকলকে আমন্ত্রণ জানাই মায়ের আরাধনায়।”