পশ্চিম মেদিনীপুর: লকডাউনে বন্ধ হয়ে যায় বাবার টেলারিংয়ের দোকান। সংসার চালাতে তাই অন্য পেশা বাছতে হয়েছে। ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করেন সংসার চালাতে। সংসারে অভাব। তার মাঝেও মেয়ে পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন দেখছে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। মেদিনীপুর জেলার পিংলার প্রণতির পর এবার এক অন্য প্রণতি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে (দশম শ্রেণীতে) অ্যারোবিক জিমন্যাস্টিক্সের (Aerobic Gymnastics) জাতীয়স্তরে সোনা জয় করার পর জিমন্যাস্টে ‘বিশ্বজয়’ করতে জাপান-ভিয়েতনামে পাড়ি দেবে মেদিনীপুরের ‘সোনার মেয়ে’ মজিদা। রেল শহর খড়্গপুরের বাসিন্দা সে। হাতেগোনা মাত্র কয়েকদিন পরেই তার বিশ্বকাপ এবং একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা। দিন-রাত এক করে পরিশ্রম করছে সে। লক্ষ্য সোনা জয়। বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বছর ১৭-র মজিদা।
প্রসঙ্গত খড়গপুর শহরের পুরাতন বাজার এলাকার বাসিন্দা মজিদা খাতুন। বাবা শেখ মজিদ, পেশায় দর্জি। তবে লকডাউনের সময় কাজ হারিয়ে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করেন খড়গপুর শহরে। কোনও রকমে চলে তাঁদের সংসার।তিনি একজন ফুটবলারও ছিলেন। বাড়িতেই ছিল খেলাধুলার চর্চা। মা রিনা বিবি গৃহবধূ। বাড়িতে রয়েছে মজিদার এক বোনও। এতদূর অবধি মজিদা এগিয়ে যেতে পেরেছে তাঁর ‘প্রথম’ প্রশিক্ষক রঞ্জিত দাস চৌধুরীর উৎসাহ আর উদ্যোগে। এখন মজিদার প্রশিক্ষক নৈহাটির সম্রাট পাল। তাঁর বাড়িতে থেকেই চলছে কঠোর প্রশিক্ষণ। প্রায় দশ বছর ধরে তার বাড়িতে থেকে অনুশীলন করছে সে। পাশাপাশি সৌভিক দাস, যিনি আন্তর্জাতিক বিচারক তিনিও সাহায্য সহযোগিতা করেন মজিদাকে। পুলিশ-প্রশাসন, পৌরসভা ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বণিক সভার সহায়তায় বিদেশে (থাইল্যান্ডে) পাড়ি দিয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর শহরের মজিদা খাতুন। খুব কষ্ট করেই নিজের জেদ নিয়ে মজিদা জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় (Asian Aerobic Gymnastics Championship) ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেছিল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ফের জাতীয় স্তরে সোনা জয় করার পর জাপানের বিশ্বকাপ এবং ভিয়েতনামের এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে (Asian Aerobic Gymnastics Championship) অংশগ্রহণ করতে চলেছে সে।
জাপানে আগামী ২৫ এবং ২৬ মে হবে বিশ্বকাপ। তার পর ভিয়েতনামে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে নামার কথা গোপালী ইন্দ্রনারায়ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী মজিদার। এই দুই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলা থেকে একমাত্র মজিদাই সুযোগ পেয়েছেন। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের পর, ২০২৩ সালেও জম্মু-কাশ্মীরে অনুষ্ঠিত জাতীয় অ্যারোবিক জিমন্যাস্টিক্সে তিনটি বিভাগে সোনা জিতেছিল মজিদা। জাপান এবং ভিয়েতনামে প্রতিযোগিতায় নামতে প্রয়োজন ছিল ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। তবে এখনও পর্যন্ত পরিবার জোগাড় করতে পেরেছেন মাত্র ৫০ হাজার টাকা। তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। বাবার সামান্য রোজগার। নিজের পরিশ্রমে তিনি চালিয়ে রেখেছেন তার এই প্রচেষ্টা। বর্তমানে জিমনাস্টিকের প্রশিক্ষণ দিয়েই নিজের অর্থ নিজেই জোগাড় করে চলেছে সে।
মজিদা বলে, “আগে বাবা দর্জির কাজ করতেন। লকডাউনে সেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে সংসার চালাতে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করেন বাবা। পড়াশোনার পাশাপাশি নৈহাটিতে সম্রাট পালের কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছি। জাপান এবং ভিয়েতনামে দেশের মোট পাঁচজন যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আর্থিক সমস্যার জন্য আমার অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। এখন মনে হচ্ছে যেতে পারব! অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছি। সোনা জিতে ফিরতে চাই!”
আরও পড়ুন: বাবা ভিক্ষা করেন! প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ করেই মাধ্যমিকে নজরকাড়া সাফল্য পড়ুয়ার
আরও পড়ুন: অভাব, প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে মাধ্যমিকে সাফল্য! ভবিষ্যতে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন শঙ্করের
২০২২ সালেও যোগ্যতা অর্জনের পর মজিদা-র থাইল্যান্ড যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। সেই বার এগিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন জেলাশাসক আয়েশা রানী, ডিস্ট্রিক্ট স্কুল স্পোর্টস, পশ্চিম মেদিনীপুর DCCI-র সাধারণ সম্পাদক চন্দন বসু, খড়্গপুরের প্রাক্তন পৌরপ্রধান প্রদীপ সরকার-সহ মজিদার স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। পাশাপাশি জেলার এক পুলিশ কর্তার ও প্রশাসনের এই কর্মকর্তার সাহায্য নিয়ে ২০২৩ সালে মঙ্গোলিয়ায় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল সে।
সামনে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোনা জয় সুনিশ্চিত করতে সে সব না ভেবে আপাতত দিন রাত এক করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মজিদা।
রঞ্জন চন্দ