বাঁকুড়া: শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছে বাঁকুড়ার মানুষ। কিন্তু কেন? বিহার থেকে এক ব্যক্তি এসে বাঁকুড়ায় বিক্রি করছেন এই গাছ। প্রথমে দেখলে শুকিয়ে যাওয়া শ্যাওলার মত দেখতে এই গাছ একেবারেই ব্যবহারযোগ্য নয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তার পাশেই সবুজ সুন্দর দেখতে যে গাছ রাখা আছে সেটিও একই গাছ। যেন কোনও এক ম্যাজিক মুহূর্তের মধ্যে শুকিয়ে যাওয়া গাছকে করে তুলেছে সবুজ সতেজ।
বাঁকুড়ার গাজনের মেলায় বিহার থেকে আসা চন্দন বীরকে এই অদ্ভুত ধরনের গাছ বিক্রি করতে দেখা গেল। এই গাছের নাম মৃতসঞ্জীবনী। শুকিয়ে যাওয়া এই উদ্ভিদ জলে ডুবিয়ে দিলেই ১২ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সবুজ তরতাজা হয়ে ওঠে। এক একটি বান্ডিল বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা, ২০ টাকা এবং ৩০ টাকা করে। আর সেই গাছ দেখতে ও কিনতে ভিড় করছে সাধারণ মানুষ। বিক্রেতা চন্দন জানান, মূলত গাজনের মেলার সময় থেকে দোকান দিতে বিহার থেকে রাঢ় বাংলায় আসেন। এই বছর হরিদ্বার থেকে মৃতসঞ্জীবনী গাছ নিয়ে এসেছেন।
রামায়ণে উল্লেখিত আছে এই গাছের কথা। মূলত সঞ্জীবনী গাছ দেখা যায় পাহাড়ি অঞ্চলে। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেই জন্ম নেয় এই গাছ। উৎসাহী মানুষেরা এই গাছ দেখে এক প্রকার অবাক হয়েছেন। অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থেকেছেন, কেউ আবার পরখ করে দেখার জন্য এই গাছ কিনে বাড়িও নিয়ে গেছেন।
কৌশিক অধিকারী, মুর্শিদাবাদ: মুর্শিদাবাদের ভরতপুর ব্লকের অন্তর্গত জজান গ্রাম।জজান গ্রামের মা সর্বমঙ্গলা কালী বহু প্রাচীন। চৈত্রের শেষ দিনে পালকিতে করে মাকালীর বিগ্রহ নিয়ে গ্রাম পরিক্রমা করা হল মশাল জ্বেলে। জানা যায়, জজান মুর্শিদাবাদের একটি অতি প্রাচীন গ্রাম। প্রাচীন নাম জয়যান। হয়তো গৌড়ের অধিপতি জয়নাগের নামাঙ্কিত ছিল এই জনপদ। পালযুগে উত্তরে ময়ূরাক্ষী, দক্ষিণে অজয়, পূর্বে ভাগীরথী ও পশ্চিমে দ্বারকা। এই চারটি নদীবেষ্টিত গৌড়সংলগ্ন উত্তর রাঢ়ের করগ্রহণের প্রধান কেন্দ্র ছিল জজান।
পালযুগে বিগ্রহপালের মৃত্যুর পর কৈবর্ত শাসনের সময়ে সাময়িকভাবে বঙ্গের বর্মণবংশের অধিকারে ছিল এই জজান অঞ্চল। জজান গ্রামে আছে মা সর্বমঙ্গলার মন্দির। বর্তমান মন্দিরটি সম্ভবত অষ্টাদশ শতকে নির্মিত। তবে মাতৃপীঠের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। মন্দির থেকে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় ৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে জজানের পাশের গ্রাম বৈদ্যপুর অধিবাসী রামেশ্বর দত্ত নামে জনৈক বণিক বৈদ্যপুরের পাশে দেবীপুরে দেবী সর্বমঙ্গলার মূর্তি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমানে অবশ্য সর্বমঙ্গলা পূজিত হন একটি মাতৃশিলায়।বিভিন্ন জায়গায় শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হলেও এই গ্রামে মাকালীর বিগ্রহ নিয়ে গ্রাম পরিক্রমা করা হয়। রাত বারোটা থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত ভক্তদের কাঁধে চেপে পালকিতে গ্রাম পরিক্রমা করা হয়। আগে গ্রামে রাস্তায় পথবাতি ছিল না, ফলে মশাল জ্বেলেই গ্রাম পরিক্রমা করা হত। আজ পথবাতি হলেও সেই মশাল জ্বেলে মা সর্বমঙ্গলার বিগ্রহ গ্রামে পরিক্রমা করানো হয়। যা দেখতে ভিড় জমান বহু সাধারণ মানুষজন।
চৈত্রের সংক্রান্তিতে গাজন উৎসবে মাতেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিভিন্ন এলাকার মানুষ রা গ্রাম বাংলার আজও সংক্রান্তিতে গাজন ও চড়ক উৎসব এর সঙ্গে জড়িত বহু প্রাচীন ইতিহাস।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা: চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজন উৎসবে মাতেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকার মানুষ। এ বহু প্রাচীন প্রথা। গ্রাম বাংলায় আজও সংক্রান্তিতে গাজন ও চড়ক উৎসব হয়। এর সঙ্গে জড়িত বহু প্রাচীন ইতিহাস। কেউ কেউ বলেন, গর্জন শব্দ থেকে এসেছে গাজন।
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী চৈত্র মাস হল শিব-পার্বতীর বিবাহের মাস। এই মাসেই তাই গাজনের দেখা মেলে বিভিন্ন এলাকায়। গাজনের পাশাপাশি গ্রাম বাংলার মানুষ আজও চড়কের উৎসবে মাতেন। চড়ক হল হিন্দুদের এক অন্যতম উৎসব। শোনা যায়, শিবভক্ত বান রাজা ইষ্ট দেবতাকে তুষ্ট করতে কঠিন সাধনার মধ্য দিয়ে তপস্যা করেন। সেই ধরেই চড়কের শিবভক্ত সন্ন্যাসীরা আজও ঝাঁপ দেন। তবে এখন গ্রামবাংলার পাশাপাশি শহরেও গাজন গানের ছবি দেখা যায়।
গ্রাম বাংলার বহু মানুষকে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় চৈত্র মাসের শুরু থেকেই বাড়ির মহিলা থেকে পুরুষরা সন্ন্যাস নেন। সারাদিন সন্ন্যাসীরা পথে পথে ঘুরে ভিক্ষা করেন। দিনভর উপবাসের পরে ভিক্ষায় মেলা চাল, সবজি রান্না করে খান। আবার অনেকেই চৈত্র মাসের শেষ কটা দিনে সন্ন্যাসীর জীবন পালন করেন। গাজনের অংশ হিসেবেই পরের দিন পালিত হয় নীল পুজো। সনাতনী ধর্ম মেনে সন্তানের মঙ্গল কামনায় গাজন সন্ন্যাসীদের ফল, আতপচাল, ডাব নারকেল দান করেন মায়েরা। অনেকে গোটা দিন উপবাস করে শিবের পুজো দেন। কেউ দিনের শেষে সাগু মাখা খান, কেউ রুটি, লুচি। আর চৈত্রের একেবারে শেষ দিনে উদ্যাপিত হয় চড়ক। গাজনতলায় হয় চড়কগাছের পুজো। চড়কগাছ মানে একটি লম্বা কাঠের দণ্ড। তার উপরে অনেকটা উঁচুতে আংটায় ঝুলে থাকা জনা সন্ন্যাসীরা ক্রমাগত ঘুরপাক খান। এ দৃশ্য আজও দেখা যায়।