পুরুলিয়া: ভাই-বোনের অটুট বন্ধনের উৎসব রাখি। বাঙালি থেকে অবাঙালি সকলের কাছেই রাখি উৎসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দিন দিদি বা বোনেরা তাঁদের ভাই বা দাদার হাতে রাখি বেঁধে দিয়ে তাঁদের মঙ্গল কামনা করেন। আর দাদা বা ভাইরাও দিদি বা বোনের রক্ষা করার শপথ নেন এই দিন। সামনেই রাখি বন্ধন উৎসব, তাতে মেতে উঠবে আপামর বঙ্গবাসী। সব জায়গাতেই বিভিন্ন ভ্যারাইটির রাখি বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে।
রাজ্যের অন্যান্য জেলার পাশাপাশি পুরুলিয়াতেও রাখি বিক্রি শুরু হয়ে গিয়েছে। পুরুলিয়া শহরের চকবাজারে দুর্দান্ত সব রাখির কালেকশন নিয়ে হাজির হয়েছেন বিক্রেতারা। ক্রেতারাও অধীর আগ্রহে দেখছেন সেই রাখিগুলি।
আরও পড়ুন: অষ্টম দিনেও আন্দোলন জারি, হাসপাতালে এসে ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা! দেখুন ভিডিও
এই বিষয়ে এক বিক্রেতা বলেন, প্রতিবছরের মত এই বছরও তিনি বিভিন্ন ভ্যারাইটির রাখি তুলেছেন। তার মধ্যে কাপল রাখি, মেয়েদের জন্য স্পেশাল রাখি সহ বিভিন্ন ভ্যারাইটি রাখি রয়েছে। রাখির দাম ৫ টাকা থেকে শুরু হয়ে ১৫০ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। অন্যান্য বছরে তুলনায় এই বছর এখনও পর্যন্ত বিক্রি খানিকটা কম রয়েছে। তবুও তিনি আশা করছেন রাখি পূর্ণিমার আগেই তাঁর দোকানে রাখি বিক্রি বাড়বে।
এই বিষয়ে এক ক্রেতা বলেন, এই দোকান থেকেই তিনি প্রতিবছর রাখি কেনেন। এই বছরও তিনি রাখি কিনেছেন। রাখির কালেকশনও বেশ ভাল রয়েছে। দামও অনেকটাই কম। তাই রাখি কিনে তিনি খুবই খুশি।
শর্মিষ্ঠা ব্যানার্জি
বাঁকুড়া: বিগত ১৮ বছর ধরে রাখি বানাচ্ছে বাঁকুড়া শহরের এক পরিবার। বিক্রি করা তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল সমাজসেবী সংগঠনদের দান করা। রাখিতে লেখা রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক বার্তাও। কিন্তু ১৮ বছর ধরে কেন এমন কাজ করছেন তারা? নেপথ্যে রয়েছে একটি সুন্দর গল্প।
বিগত ১৮ বছর ধরে প্রায় পাঁচ থেকে সাত হাজার রাখি তৈরি করেন বাঁকুড়ার কুচকুচিয়া ফাঁসিডাঙার পোদ্দার পরিবার। রবীন্দ্রনাথের রাখি বন্ধনকে সম্মান জানিয়ে শুরু হয়েছিল এই কর্মসূচি। প্রথমে অনুশীলন সমিতিকে রাখি দেওয়া হয়েছিল। এর পর ধীরে ধীরে সংযুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সমাজসেবী সংগঠন।
আরও পড়ুন- ‘এইটা’ দেখলেই নাক সিঁটকান? খাসির কোন অঙ্গ থেকে তৈরি হয় বলুন তো দেখি!
প্রতি বছর সংগঠনগুলির হাতে রাখি তুলে দেন পোদ্দার পরিবার। স্বামী, স্ত্রী এবং ছেলে, মেয়ে রাখি বন্ধনের আগেই শুরু করে দেন রাখি তৈরির কর্মশালা। সারা বছর তাঁরা জমা করেন পরিবারের ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র যেমন, নারকেলের ছোবড়া, সিল্কের কাপড়, ওষুধের পাতা , রঙিন কাগজ এবং আরও কত কী! এই জিনিসগুলি ব্যবহার করে তাঁরা তৈরি করেন সুন্দর সুন্দর রাখি। এই বছরও প্রায় ৪ হাজার রাখি এখনও প্রস্তুত হয়েছে।
শুধুমাত্র ব্যবহারযোগ্য জিনিস দিয়ে রাখি বানানো ছাড়াও সমাজের প্রতি প্রতিবছরই নতুন ধরনের বক্তব্য রাখতে চান পোদ্দার পরিবার। ২০২৪ সালে রাখি পূর্ণিমার আগে তাঁদের নতুন উদ্যোগ, “একটি গাছ একটি প্রাণ” বা, গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান” এবং “রক্তদান মহান দান”। হাতে তৈরি করা রাখির উপরে লিখে ফেলা হচ্ছে এই স্লোগানগুলি।
যাতে রাখি বন্ধনের মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে পড়তে পারে সচেতনতার বার্তা। দুর্গা প্রসাদ পোদ্দার জানান, “২০২৪ সাল কে ধরে প্রায় ১৯ বছর ধরে এই কাজ করছি আমরা। আমার বাবার অনুপ্রেরণায় শুরু করেছিলাম। প্রতি বছর চার থেকে সাত হাজার রাখি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনদের হাতে তুলে দিই। এই বছর কয়েকদিন আগেই আমার মা মারা গেছেন। এই রাখিগুলি মাকে উৎসর্গ করতে চাই।”
একবার দু’বার নয়। প্রতি বছর ধারাবাহিকতার সঙ্গে প্রায় ১৮ বছর যাবত রাখি তৈরি করে সমাজ সংস্কারের কাজ করার চেষ্টা করছে পোদ্দার পরিবার। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হতে পারে রাখি পূর্ণিমার আগে কয়েক দিনের প্রচেষ্টায় এই রাখিগুলি তৈরি হয়। কিন্তু পরোক্ষভাবে সারা বছর সংগ্রহ করা হয় রাখি তৈরি সরঞ্জাম। গৃহস্থ বাড়িতে দৈনন্দিন জীবনে বহু পণ্য বর্জ্ হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। পোদ্দার পরিবার এগুলি ফেলে না দিয়ে ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার রাখি তৈরি করেন।
নীলাঞ্জন ব্যানার্জি
পশ্চিম মেদিনীপুর: বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার পাশাপাশি মনুষ্যত্ব এবং সৃজনশীল ভাবনার বিকাশ ঘটে। প্রাথমিকভাবে এই পাঠ বিদ্যালয় থেকেই শুরু হয়। বর্তমানে অভিভাবকদের সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ানোর মানসিকতা অনেকটাই কমে গিয়েছে, তবে জেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা রাখিবন্ধন উৎসবকে সামনে রেখে যা করেছে জানলে আপনিও চমকে যাবেন। এর নেপথ্যে রয়েছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। প্রতিবছরের মত এবারও তাঁরা পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সৃজনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে।
আমরা সবাই জানি বিদ্যালয় শুধুমাত্র পড়াশোনার জায়গা নয়, বরং তার থেকে অনেক বেশি কিছু। আসন্ন রাখি বন্ধন উৎসবকে সামনে রেখে বিদ্যালয়ের কচিকাঁচা পড়ুয়ারা ফেলে দেওয়া বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব সরঞ্জাম দিয়ে তৈরি করছে রং-বেরঙের রাখি। যা তারা বিদ্যালয়ের বন্ধুদের একে অপরকে পরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য প্রিয়জনের হাতে বেঁধে দেবে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার প্রান্তিক এলাকায় সরকারি বিদ্যালয়ের এই আয়োজন সত্যিই অবাক করার মত।
আরও পড়ুন: ছোট থেকে আজও এই নেশায় বুঁদ, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের কাণ্ড শুনলে চমকে উঠবেন
এই ডিজিটাল যুগে বিভিন্ন হস্তশিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। কচিকাঁচাদের মধ্যে চোখে পড়ছে সৃজনশীলতার অভাব। তাই তাদের মানসিকতা ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশের জন্য মেদিনীপুর সদর ব্লকের পলাশী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্যোগে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আয়োজিত হয়েছে রাখি তৈরির কর্মশালা। যেখানে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং স্কুলের সংগ্রহ করা বিভিন্ন ফলের বীজ ও রঙিন কাগজ এবং উল দিয়ে তৈরি করছে সুন্দর সুন্দর রাখি। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানিয়েছেন, পড়াশোনার পাশাপাশি কচিকাঁচাদের হাতে-কলমে শিক্ষা দিতেই মূলত এই আয়োজন।
রাখিবন্ধন উৎসবে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী একে অপরের হাতে এই রাখি বেঁধে দেবে। তবে এর উপাদান পরিবেশের কোনও ক্ষতি করবে না। তাই বিদ্যালয়ের এই অভিনব আয়োজনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকেই।
রঞ্জন চন্দ
দক্ষিণ দিনাজপুর: রাখি বন্ধন উপলক্ষে স্বাভাবিকভাবেই বাজার ভরে গিয়েছে বাহারি রাখিতে। তবে উল বা ফুলের রাখি, কিংবা রংবেরঙের কাগজের রাখি, এসব এখন অতীত। সবাই চান, সবচেয়ে সুন্দর রাখি কিনতে নিজের ভাইয়ের জন্য। তাই এই বছরের রাখিতে নতুন চমক। বালুরঘাট শহরের রঘুনাথপুর এলাকার বাসিন্দা ইন্দ্রানী সরকার তৈরি করে ফেলেছেন ক্লে ও ফেব্রিক দিয়ে রকমারি রাখি। বর্তমান দিনে আধুনিকতার চাকচিক্য থেকে একটু সরে এসে রাখিতে একটু অভিনবত্বের ছোঁয়া। যা ইতিমধ্যেই বালুরঘাট শহরে বেশ সাড়া ফেলেছে।
প্রসঙ্গত, রাখি বন্ধন উৎসব মানে একে অপরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বেঁধে রাখার একটি আনুষ্ঠানিক প্রয়াস মাত্র। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে কবিগুরু কলকাতা, ঢাকা ও সিলেট থেকে কয়েক হাজার হিন্দু ও মুসলিম ভাই-বোনেদের একত্রিত করে রাখি বন্ধন পালনের আবেদন জানিয়েছিলেন। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে খোলা বাজারে পসরা সাজিয়ে বিভিন্ন ধরনের রাখি বেচাকেনা করতে দেখা যায় দোকানিদের। তবে, এই বছর বাজারের দোকানে নয়, ক্লে দিয়ে রাখি তৈরি করে ভাল অর্ডার পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি। তাই চাহিদা ব্যাপকভাবে থাকায় ইন্দ্রানীদেবী রীতিমতন রাত দিন এক করে তৈরি করছেন তাঁর হাতে তৈরি রাখি।
আরও পড়ুন: নেশামুক্ত ভারত গড়তে সাইকেলে কেদারনাথ যাত্রা
এই বিষয়ে রাখি বিক্রেতা ইন্দ্রানী সরকার জানান, ছোট থেকেই আঁকার প্রতি তাঁর ভালবাসা রয়েছে। প্রায় দু’বছর ধরে ফেব্রিক ও তুলির টানে ফুটিয়ে তোলেন বিভিন্ন জিনিসের উপর রকমারি ডিজাইন। প্রথম অবস্থায় তেমন চাহিদা না থাকলেও বর্তমানে তাঁর হাতে তৈরি ডিজাইনের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। চলতি বছরে ক্লে ও ফেব্রিক দিয়ে বিভিন্ন জিনিসের আদলে তৈরি এই রাখি একটু ভিন্ন ধরনের। যা খুব সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে সকলের। দামও সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যেই। মাত্র ৩০ টাকা থেকে ৮০ টাকার মধ্যেই। ফলে সকলেই সাধ্যমত রাখি কিনতে পারছেন।
অনেকে মনে করেন, উল বা ফুলের রাখির পরিবর্তে ক্লে দিয়ে তৈরি রাখি কেনাই ভাল। কারণ অন্য সব রাখি পরালে কিছুদিন পরেই তা সকলেই খুলে ফেলে। এমনকি ফুলের রাখি নষ্ট হয়ে যায় সহজেই। কিন্তু এই রাখি একবার পরালে খুলতে মন চাইবে না। খুললেও তা ফেলে না দিয়ে সযত্নে রেখে দেবেন দাদা ও ভাইয়েরা। এমনকি, সচরাচর বালুরঘাটে দেখা যায় না বললেই চলে। তাই প্রতিবার রাখিতে কিছুটা নতুনত্ব থাকলেও এবছর শহরবাসীর নজর কাড়ছে ইন্দ্রানীদেবীর তৈরি রাখি।
সুস্মিতা গোস্বামী