জলপাইগুড়ি: প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার কাছে মানুষ বড়ই অসহায়। আবারও একবার সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল। এবার বিনা মেঘে বজ্রপাতে বেঘোরে প্রাণ গেল এক মেষপালকের। আকাশে মেঘ নেই, বৃষ্টি হচ্ছে না। তাও বাজ পড়ে এমন মর্মান্তিক পরিণতি যে কারোর হতে পারে সেটা বেশিরভাগেরই ধারণার বাইরে ছিল।
উত্তরবঙ্গে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার নতুন নয়। গত কয়েকদিন গরম ক্রমশই বাড়ছে। তীব্র গরমে হাঁসফাস অবস্থা সাধারণ মানুষের। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেও রোদের প্রখর তাপে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয় জলপাইগুড়িবাসীর। তবে আচমকাই একবার ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়। তাতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছিল। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ফের রোদ ওঠে। ফলে আবারও অস্বস্তি ফিরে আসে। এরই মাঝে মেঘহীন আকাশ থেকে বাজ পড়ে জলপাইগুড়ি সংলগ্ন ডুয়ার্সের গুরজং চা বাগান এলাকায় মৃত্যু হল এক মেষপালকের।
আচমকা এই ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছে গুরজং ঝোড়া চা বাগানের কর্মচারী ও শ্রমিক পরিবারগুলো। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার চড়া রোদের পর দুপুরের দিকে ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয় এই চা বাগান সংলগ্ন এলাকায়। সেই সময়ে মাঠে ছাগল চড়াতে গিয়েছিলেন রাঙামাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের গুরজং ঝোড়া চা বাগানের মন্দির লাইনের বাসিন্দা বিষ্ণু নায়েক। তবে বৃষ্টি পড়ছিল না। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচমকাই বজ্রপাত হয়। তার আঘাতে মাঠের মধ্যে লুটিয়ে পড়েন বিষ্ণু। গ্রামবাসীরা তড়িঘড়ি ছুটে এসে তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় মাল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক বিষ্ণু নায়ককে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
মালদহ: মালদহে বজ্রপাতে মৃত চার। পৃথক পৃথক ঘটনায় এ পর্যন্ত চারজনের মৃত্যু। বৃহস্পতিবার দুপুরে আচমকা বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি মালদহে। পুরাতন মালদহের সাহাপুরে একইসঙ্গে তিন জনের মৃত্যু। আম বাগানে আম কুড়ানো ও পাহাড়ার কাজ করার সময় বাজ পড়ে মৃত্যু হয় ওই তিন জনের। মৃতদের চন্দন সাহানি(৪০), রাজ মৃধা(১৬) ও মনোজিৎ মণ্ডল(২১)।
অন্যদিকে গাজোলের আদিনাতে আম বাগানে বজ্রপাতে মৃত একাদশ শ্রেণির ছাত্র অসিত সাহা (১৯)। ঝড়ের সময় আমবাগানে আম কুড়াতে গিয়ে বিপত্তি। আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনায় শোকের ছায়া পরিবারে। চারটি মৃতদেহই আনা হয়েছে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
বজ্রপাতের ঘটনায় এক গৃহবধূ সহ আরও দু’জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন ইংরেজবাজারের বুধিয়ার ফাতেমা বিবি, অন্যজন পুরাতন মালদহের সাহাপুরের বাসিন্দা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র দুল্লু মণ্ডল। আহতদের চিকিৎসা চলছে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সকাল থেকে প্রচন্ড গরমের পর দুপুরে হঠাৎই আকাশ কালো করে ঝড় বৃষ্টি নামে। তখনই ঘটে চারটি মৃত্যুর ঘটনা।
মুর্শিদাবাদ: ফের বজ্রাঘাতে মৃত্যু হল এক কৃষকের। সুতির মহিশাইল গ্রামের ঘটনা। ওই গ্রামেরই কৃষক তাজেল শেখ (৫১) চাষের জমিতে শসা তুলতে গিয়েছিলেন। সেই সময়ই হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বজ্রপাতে মৃত্যু হয় ওই কৃষকের।
মৃত কৃষকের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, এখন রোজ সন্ধেতে ক্ষেত থেকে শসা তুলতে যান তিনি। দুই নাতিকে সঙ্গে নিয়ে মঙ্গলবারও একই কাজে গিয়েছিলেন। হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে দুই নাতিকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনাও দেন তাজেল। বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে চাননি। কিন্তু ছোট দুই নাতি ছুটে বাড়ি চলে গেলেও হঠাৎ বজ্রপাতে গুরুতর জখম হন ওই কৃষক।
সঙ্গে সঙ্গে পরিজন ও গ্রামবাসীরা গুরুতর আহত অবস্থায় তাজেল শেখ-কে মহিশাইল ব্লক হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসে সুতি থানার পুলিশ। ওই কৃষকের দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে পাঠানো হয়। এদিকে বজ্রপাতের জেরে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় বেশ ভীত কৃষকরা।
পূর্ব মেদিনীপুর: আর পাঁচটা দিনের মত মাঠে কাজ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু আর বাড়ি ফেরা হল না গৌতম জানার। দুপুরের ঘনিয়ে আসা কালো মেঘ অন্ধকারে ঢেকে দিল তাঁর গোটা পরিবারকে। এই যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ গোটা গ্রাম।
সকালে রোদ ঝলমলে আকাশ দেখে চাষের ক্ষেতে রোজের মত কাজ করতে গিয়েছিল গৌতম। কিন্তু দুপুরের পর কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। সঙ্গে শুরু হয় ঝড় ও বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি। বাড়ি ফেরার আগেই বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয় তাঁর। ঘটনাটি ঘটেছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পটাশপুর-২ ব্লকের খাড়গ্রাম পঞ্চায়েতের খড়ুই পশ্চিমসাই গ্রামে।
বর্তমানে বৃষ্টির সঙ্গে ব্যাপক বজ্রপাত হচ্ছে। তাতে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। নিজের বাদাম ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে মর্মান্তিকভাবে গৌতম জানারও মৃত্যু হল। বছর ৩৮-এর গৌতমবাবুর বাড়িতে স্ত্রী, মা-বাবা ও সন্তানেরা রয়েছে।
মৃতের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বাদাম চাষের মাঠে কীটনাশক স্প্রে করতে গিয়েছিলেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বজ্রবিদ্যুত সহ ঝড় বৃষ্টি নামে। ঝড় বৃষ্টি থেমে গেলেও দীর্ঘক্ষণ গৌতম বাড়ি না ফেরায় পরিবারের সদস্যরা বাদাম চাষের ক্ষেতে গিয়ে দেখতে পান, চাষের ক্ষেতের মধ্যেই লুটিয়ে পড়ে রয়েছে তিনি। বাড়ির লোকজন ও প্রতিবেশীরা মিলে মাঠ থেকে গৌতমের ঝলসানো দেহ বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় পটাশপুর হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন।
কলকাতা: আগামী দু’ঘণ্টার মধ্যেই ধেয়ে আসতে চলেছে প্রবল বেগে ঝড়। সঙ্গে হতে পারে মাঝারি বৃষ্টিও। ঝড়ের জেরে বিপর্যস্ত হতে চলেছে কলকাতার পাশের দুই জেলা। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, হাওড়া এবং হুগলি জেলায় আগামী দুই ঘণ্টার মধ্যে ঝড় আসতে চলেছে।
শুধু ঝড় নয়, বৃষ্টিরও পূর্বাভাস রয়েছে হাওড়া এবং হুগলি জেলায়। ৫০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে হাওড়া এবং হুগলি জেলার কিছু এলাকায়। বজ্রবিদ্যুৎ-সহ হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টির সতর্কতা জারি করেছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর। আগামী দু’ঘণ্টার মধ্যে ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস জারি হয়েছে কলকাতাতেও। এ বার কলকাতার পার্শ্ববর্তী দুই জেলাতে ঝড়বৃষ্টির সতর্কতা জারি করল হাওয়া অফিস।
আগেই হাওয়া অফিস জানিয়েছে, শনিবার বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে দক্ষিণবঙ্গে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের অনেক জেলাতেই ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো বাতাস বইবে। ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনাও রয়েছে কয়েকটি এলাকায়। এর মধ্যেই হাওড়া এবং হুগলি জেলার ঝড়বৃষ্টি সম্ভাবনা আছে বলে জানাল হাওয়া অফিস। কমলা সতর্কতা জারি হয়ে এই দুই জেলায়। যারা বাড়ির বাইরে আছেন তাদের বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
পশ্চিম মেদিনীপুর: টানা তাপপ্রবাহ শেষে সোমবার বিকেলের পর দক্ষিণবঙ্গের বেশিরভাগ জেলায় নেমে আসে অঝোর ধারায় বর্ষণ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমজনতা। হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস মত সোমবার বিকেল থেকে জেলার বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয় ঝড়ো হাওয়া, সঙ্গে বৃষ্টি। সকলের প্রাণ জুড়োলেও আনন্দের এই বৃষ্টি সবার কাছে সুখকর হল না। ঝড়ে এবং বৃষ্টিতে গাছ থেকে পড়া আম কুড়াতে গিয়ে মর্মান্তিক পরিণতি হল এক যুবকের।
মর্মান্তিক ঘটনাটি পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার। সোমবার বিকেল থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। বেশ কিছু জায়গায় বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই ঝড়ো হাওয়া এবং বৃষ্টির কারণে ঝরে পড়েছে গাছের কাঁচা আমও। বাড়ির পাশে আম গাছ থেকে ঝরে পড়া আম কুড়োতে গিয়ে বজ্রাঘাতে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় এক যুবকের। মৃতের নাম পিন্টু সামন্ত (৩২)। বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার দঙ্গলসা এলাকায়।
পরিবার সূত্রে খবর, মৃত পিন্টুর বাড়িতে স্ত্রী, চার মাসের সন্তান, বাবা, মা ও দাদা রয়েছেন। অস্থায়ী ফলের দোকান ছিল পিন্টুর। দোকানের কষ্টার্জিত অর্থে চলত সংসার। তবে এদিন সন্ধে নাগাদ বাড়ির পাশে আম গাছে ঝরে পড়া আম কুড়োতে গিয়ে বজ্রাঘাতে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তাঁর। পিংলা গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃতের এক নিকট আত্মীয় নিশিকান্ত বেরা বলেন, কালবৈশাখী ঝড়ে বাড়ির সামনে আম কুড়োতে গিয়ে বিদ্যুতের ঝলকানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় পিন্টু। এক দাদা উদ্ধার করে ওকে বাড়িতে আনে। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে গেলেও প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
রণদেব মুখোপাধ্যায়, কাটোয়া: বজ্রপাতে মৃত্যু হল পোষ্য সহ এক মহিলার। কাটোয়া থানার কামাল গ্রামের মাঝিপাড়ার ঘটনা। আত্মীয়স্বজনেরা গুরুতর জখম উন্নতি মাঝি (৪৯)কে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত বলে জানিয়ে দেন।
সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ ঝড় বৃষ্টির সময় বাড়ির পোষা ভেড়াকে ঘরে তুলতে বাড়ির কাছে পুকুরঘাটে গিয়েছিল, সেই সময় উন্নতির কাছেই বাজ পড়ে। ঘটনাস্থলেই ভেড়া সহ উন্নতির মৃত্যু হয়।
এদিকে, সোমবার রাতে কলকাতার স্ট্র্যান্ড রোডে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হল এক চা বিক্রেতার৷ ফুটপাতের উপরে বিদ্যুতের খোলা তারে সংস্পর্শে এসেই ওই চা বিক্রেতার মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ৷ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ৷
জানা গিয়েছে, মৃত ওই চা বিক্রেতার নাম সুভাষ অধিকারী (৩৭)৷ সোমবার বিকেলে ফুটপাথে রাখা একটি ঝাঁটা তুলে আনতে যান ওই যুবক৷ তখনই একটি বেসরকারি সংস্থার লাগানো আলোর তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন তিনি৷
প্রতি বছরই দেখা যায় কালবৈশাখীর ঝড়। ভারতে সব রাজ্যেই বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। কিন্তু কেন হয় বজ্রপাত? কী ভাবেই সাবধান থাকা যায়? বজ্রপাতের সময় কোথায় আশ্রয় নেবেন? সবটা বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে জেনে নিন।